এক সময় সংবাদমাধ্যমের প্রতি অগাধ আস্থা ছিল মানুষের। শুধু জনসাধারণ নয়; গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকারকে সক্রিয়, সজীব করে তুলতে ও রাখার ক্ষেত্রে সাংবাদিকের লেখনীতে অগাধ বিশ্বাস ছিল গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রনায়কদেরও। সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৭৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন বলেছিলেন, সংবাদপত্র ছাড়া সরকার কিংবা সরকার ছাড়া সংবাদপত্র- এ দুটি পরিস্থিতির মধ্যে একটি বেছে নিতে বলা হলে আমি দ্বিতীয়টিকেই অগ্রাধিকার দিতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করব না।
প্রশ্ন হলো, পাঠক কি সংবাদপত্রকে আজও এভাবে বিশ্বাস করেন? যদি না করেন তাহলে কেন? সংবাদপত্র কি প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে? মালিকানা কি সত্যিই এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা? নাকি এসব সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে সরকারি চাপ রয়েছে?
সাম্প্রতিক একটি গবেষণার তথ্য বলছে- সংবাদমাধ্যমগুলো এখন তার প্রচারিত, প্রকাশিত তথ্য দিয়ে জনমানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। এই গবেষণার তথ্যমতে, ১৩৯ জনে ৯৯ জনই বলেছেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তাঁরা সন্দিহান। ইউএসএইডের গবেষণার তথ্য বলছে, প্রকাশিত সংবাদের আধেয় বিশ্নেষণে সংবাদে ভারসাম্য, বস্তুনিষ্ঠতা, সত্যতা- এই তিনটির উপস্থিতি সবচেয়ে কম। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায়, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে সবার আগে তথ্য দিতে গিয়ে ভুল তথ্য প্রকাশ করছে অনেক সংবাদমাধ্যম, যা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ উপস্থাপনের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এমনকি সংবাদে ভুল তথ্য থাকায় পাঠকও বিভ্রান্ত হচ্ছেন। আরেকটি কারণে এ প্রসঙ্গ টানা যায়। বিশ্ব গণমাধ্যম সূচকে প্রতি বছরই অবস্থানের অবনমন ঘটছে বাংলাদেশের। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স প্রকাশিত ২০২২ সালের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১৬২তম। ২০২১ সালে অবস্থান ছিল ১৫২তম। শুধু তাই নয়, এবারের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে।
যদিও সাংবাদিকরা বলছেন, খবরদারি, কালাকানুন এই অবনমনের পেছনে বিশেষভাবে দায়ী। দেশের সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্রীয়, আইনি, ধর্মীয় চাপসহ নানা কারণে সত্য প্রকাশ করতে পারছে না। তবে এসব কারণের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের সংখ্যা বৃদ্ধি; সংবাদপত্র ও প্রকাশিত তথ্যের প্রতি আস্থা আর বিশ্বাস হারানো ছাড়াও করপোরেটাইজেশন, সেলফ সেন্সরশিপের প্রভাবও রয়েছে বলে মনে করা যায়।
বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের সংখ্যার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গত দুই দশকে। গাণিতিক হারে বাড়ছে এই সংখ্যা। নিবন্ধিত পত্রপত্রিকা সম্পর্কিত চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত মোট পত্রিকার সংখ্যা ৩ হাজার ১৫৪টি। যার মধ্যে ১ হাজার ২৬৫টি দৈনিক, ৩টি অর্ধ সাপ্তাহিক, ১ হাজার ১৯৪টি সাপ্তাহিক, ২১২টি পাক্ষিক, ৪৩৫টি মাসিক। এ ছাড়া বাকি পত্রিকাগুলো দ্বিমাসিক, ত্রৈমাসিক, চতুর্মাসিক, ষাণ্মাসিক এবং বার্ষিক পত্রিকা। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, মিডিয়ার বিচ্ছুরণ ঘটেছে বাংলাদেশে। এর বাইরে আছে ৪৫টি টেলিভিশন।
বাস্তবতা হচ্ছে, প্রথম সারির অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমের মালিকানা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কাছে। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের এক গবেষণায় ১৯৯৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও, ওয়েব পোর্টাল মিলিয়ে ৪৮টি সংবাদমাধ্যমের মালিকানা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এতে সংবাদমাধ্যম মালিকদের তিনটি প্রধান প্রবণতা লক্ষণীয়- ক্ষমতাসীন দলের সংশ্নিষ্টতা, পরিচালকদের পারিবারিক সম্পর্ক, অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে যুক্ততা।
অভিযোগ রয়েছে- ব্যবসার বিনিয়োগ সুরক্ষিত করতেই শিল্পোদ্যোক্তাদের প্রয়োজন হয় সংবাদমাধ্যম। কখনও কখনও ব্যবসার প্রসার বা অন্য শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যও সংবাদমাধ্যমের প্রয়োজন হয়।
কখনও কখনও সমাজের বিভিন্ন অসংগতিতে ওয়াচ ডগ হিসেবে কাজ না করে বরং সংবাদমাধ্যম সংশ্নিষ্ট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রক্ষার ওয়াচ ডগে পরিণত হয়। এসব কারণে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার রক্ষা, সমাজের সামষ্টিক মঙ্গল, ন্যায়বিচারের সংগ্রাম, সমতা, ন্যায্যতা ও ন্যায়সংগত সমাজ গঠনের মতো ধারণা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জবাবদিহির আওতায় আনা
সম্ভব হচ্ছে না দুর্বৃত্তদের। ফলে অনেক সংবাদমাধ্যম তার ওপর ন্যস্ত চতুর্থ স্তম্ভের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছে না।
বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের আরেকটি বাধা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় চাপ। সরকারি দপ্তরের তথ্য গোপন করার সংস্কৃতিতে তথ্য অধিকার আইনটির কার্যকর ব্যবহার আমরা লক্ষ্য করছি না। এর ফলে জনগণের তথ্য সরকারি সম্পত্তিতে রূপ নিয়েছে এবং নিয়ন্ত্রণ করছে সরকারি প্রতিষ্ঠান; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমলারা। এতে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা যেভাবে যতটুকু তথ্য প্রকাশ করতে চাইছেন, ঠিক ততটুকুই প্রকাশিত হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতাবানরা তাঁদের দোষ-ত্রুটি, ভুল পদক্ষেপের বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের সমালোচনামূলক লেখা সহ্য করতে পারছেন না। সত্য প্রকাশ করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ অন্যান্য আইন গণমাধ্যমসহ সংবাদকর্মীদের টুঁটি চেপে ধরছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের তিন বছরে করা মামলায় অভিযুক্তদের একটি বড় অংশ (২৫ শতাংশ) সাংবাদিক। এসব বিবেচনায় সঠিক তথ্য প্রকাশ ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। তথ্য প্রকাশ ও সাংবাদিকতার ওপর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই বাড়ছে।
অন্যদিকে সুনামির মতো এসেছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল। এসব পোর্টালের একটি বড় অংশে সত্য তুলে ধরার চেয়ে অপতথ্যের প্রাচুর্য মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। সংবাদপত্রের মূল কাজ হলো, সত্য সংবাদ প্রকাশ করা। কিন্তু অনলাইন পোর্টালগুলোতে তথ্যের সঙ্গে অপতথ্য, ভুয়াতথ্যও উঠে আসছে, যা সাংবাদিকতার আদর্শের পরিপন্থি।
অবশ্য দেশের সব সংবাদমাধ্যম বিশ্বাসযোগ্য এবং সত্য প্রকাশ করতে পারছে না- পরিস্থিতি এমন নয়। টেলিভিশন, সংবাদপত্রসহ প্রধান সারির কিছু সংবাদমাধ্যমে আস্থা আছে মানুষের। সে বিষয়টিও গবেষণার তথ্য থেকে পাওয়া যায়।
দেশের অন্যতম প্রধান সংবাদপত্র দৈনিক সমকাল প্রতিষ্ঠার ১৮ বছরে পদার্পণ করেছে। সংবাদপত্রের সংখ্যার প্রাচুর্য, বিশ্বাসহীনতা, অপতথ্য প্রকাশের সংস্কৃতির মধ্যেও দৈনিক সমকাল পাঠকের সামনে 'অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস' নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক্সক্লুসিভ সংবাদ ছাড়াও দুর্নীতি, অপরাধের বিষয়ে অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশের মধ্য দিয়ে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে চলেছে পত্রিকাটি।
সত্য তথ্যের ভিত্তিতে বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ প্রকাশের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই পাঠকদের নিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছে পত্রিকাটি। পাঠক হিসেবে সমকালের কাছে প্রত্যাশা- সব কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে সত্যের স্ম্ফুরণ ঘটানোর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।
ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়