নতুন শতাব্দীর (২০০০) সূচনালগ্নের কথা। মে মাসের এক সন্ধ্যায় কলকাতায় বাংলা সাহিত্যের এক মহিরুহ অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাড়িতে সৌজন্য সাক্ষাৎকারের জন্য হাজির হয়েছেন সদলবলে পাক্ষিক অনন্যার নির্বাহী সম্পাদক দিল মনোয়ারা মনু। সেই ছোট্ট দলে বাংলাদেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী সাঈদা খানম, সাঈদা আপার স্নেহধন্য কলকাতা নিবাসী ডোরা রায় চৌধুরীর সঙ্গে ছিলাম আমিও। আমি তখন অনন্যাতে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছি। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে অন্নদাশঙ্কর রায়কে ঘিরে গোল হয়ে বসলাম সবাই। এবার পরিচয় পর্ব। একে একে সবার নাম ও পেশা বলে পরিচয় দিচ্ছি আমরা। দিল মনোয়ারা মনু নামটি শুনে নড়েচড়ে বসলেন তিনি। কানের শ্রবণ যন্ত্রটি ঠিকঠাকভাবে লাগানো আছে কিনা দেখে নিয়ে বললেন 'দিল? দিল মানে তো মন? তোমার নামের অর্থ তবে হৃদয় বা মন? তাই তো?' আন্টি স্মিত হেসে বললেন- 'হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন।' এবার ৯০ পেরিয়ে আসা এই বর্ষীয়ান মানুষটির মুখে হাসি ফুটে উঠল। তাঁর চোখ-মুখের অভিব্যক্তিতে খুশির উজ্জ্বল এক আভা ছড়িয়ে পড়ল।

২২ বছর আগে দিল মনোয়ারা মনু যখন পাক্ষিক অনন্যার নির্বাহী সম্পাদক, তখন সেখানে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করি। ইকবাল রোডে অবস্থিত অনন্যা অফিসে একই রুমে বসতাম আমরা। খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে; কখন যে গুরু-শিষ্যের মোড়ক ছেড়ে তাঁর পরিবারের একজন হয়ে উঠলাম- তা নিজেও টের পাইনি।

তাঁকে ঘিরে সমৃদ্ধ আমার স্মৃতির ভান্ডার। এই ছোট পরিসরে সামান্য শব্দের ভেলায় তুলে ধরা সম্ভব নয় তার সবটুকু। গড়পড়তার বাঙালি নারীর তুলনায় অনেক লম্বা-চওড়া, মৃদুভাষী এই মানুষটি ছিলেন আক্ষরিক অর্থে সংস্কৃতিবান। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'কমল হীরেটা হলো শিক্ষা আর ঐ হীরে থেকে যে দ্যুতি ঠিকরে বের হয় সেটি হলো সংস্কৃতি'। রবীন্দ্রানুরাগী মনু আন্টির মননশীলতায়, আচার ব্যবহারে আর প্রতিদিনের জীবনচর্চায় এই দ্যুতির উপস্থিতি আমাদের সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখত।

সাপ্তাহিক বেগমের মতো জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমণ্ডিত পত্রিকা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত আনকোরা পাক্ষিক অনন্যাতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি সম্ভবত ১৯৮৮ সালে। একটি পত্রিকা যদি সমাজ দর্পণ হয়, তবে পত্রিকা অফিসকে বলা যেতে পারে একটি একান্নবর্তী পরিবার। অনন্যা পরিবারের মধ্যমণি রূপে এই নারী সব সহকর্মীর সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন অচিরে। দীর্ঘ ২৫ বছরের কর্মজীবনে অক্লান্ত পরিশ্রমে, সীমিত সুযোগ ও নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে পাক্ষিক অনন্যাকে তিনি গড়ে তুলেছিলেন প্রতিশ্রুতিশীল নারী সাংবাদিকদের জন্য এক স্বতন্ত্র প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। অনন্যা শীর্ষ দশ নারী সম্মাননা প্রবর্তন তাঁর এক অমর কীর্তি, যার মধ্য দিয়ে এ দেশের সংগ্রামী নারীসমাজ নিজকর্মের স্বীকৃতি লাভ করে ক্ষমতায়নের পথে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত হয়েছে।

সে আমলে দেশে সারাক্ষণ হরতাল বা ধর্মঘট লেগেই থাকত। সময়মতো পত্রিকা প্রকাশ করা সত্যি কঠিন ছিল। সেই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও তিনি অফিস তেমন কামাই করতেন বলে মনে পড়ে না। বরং আমরা অনেকেই মাঝে মধ্যে ফাঁকি দেওয়ার টালবাহানা খুঁজে বেড়াতাম। তারপরও সেই অনন্যা তাঁকে একদিন বাধ্য হয়ে ছেড়ে আসতে হয়। এর চেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় আর কী হতে পারে?

মনু আন্টির মতো কাছের ও ভালোবাসার মানুষ কখনও আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যান না। অদৃশ্যভাবে আমাদের সঙ্গেই পথ চলেন নিভৃতে, নিঃশব্দে। চোখে না দেখলেও তাঁদের উপস্থিতি আমাদের অনুভবে ধরা পড়ে। তাই মনু আন্টিকে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলি- 'আপনার সারাটি জীবন ধ্রুবতারা করে রেখে দিলাম, আমরা জেগে রইলাম।'

উপমা দাশগুপ্ত: সাবেক স্টাফ রিপোর্টার, পাক্ষিক অনন্যা