
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি, জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দলীয় নেতাকর্মী হত্যা, হামলা ও মামলার প্রতিবাদে শনিবার ময়মনসিংহে বিভাগীয় গণসমাবেশ করেছে বিএনপি। সমাবেশে যোগ দিতে যাওয়ার পথে পথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাধার পরও যে জনসমাগম হয়েছে, তা ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটিকে উজ্জীবিত করতেই পারে। দুই মাস ধরে লাগাতার সভা-সমাবেশ ও প্রতিবাদ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকা এবং ক্রমেই জনসমাগম বাড়ার এই চিত্র বিএনপিকে কতটা ভরসা দিতে পেরেছে? নিজেদের দাবি আদায়ে সক্ষমতা কতটা জানান দিতে পারল দলটি?
শনিবার সমকালে প্রকাশিত একটি সচিত্র সংবাদে বলা হয়েছে- ময়মনসিংহ পলিটেকনিক মাঠে বিএনপির গণসমাবেশের আগের রাতে শুক্রবারেই সেখানে নেতাকর্মীরা জড়ো হয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, বিএনপির সমাবেশ কেন্দ্র করে ময়মনসিংহকে সড়ক পথে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল। জনসমাগম ঠেকাতে বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার আঞ্চলিক গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। নেত্রকোনা, শেরপুর, গাজীপুর, ত্রিশাল, গফরগাঁও এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা এমনকি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিপরীতে সমাবেশে উপস্থিত হতে বিএনপি নেতাকর্মীরা হেঁটে গন্তব্যে যাওয়ার পথ বেছে নিয়েছেন। আবার দেখা গেছে, যেখান থেকে নৌপথের সুযোগ রয়েছে তাঁরা নদীপথ বেছে নিয়েছেন।
সন্দেহ নেই, ময়মনসিংহের সমাবেশ বদলে যাওয়া এক বিএনপির কথাই বলছে। শনিবার সমকাল অনলাইনে প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদের শিরোনাম পরিস্থিতি বুঝতে সহায়তা করবে: বিএনপির সমাবেশে যাচ্ছে সন্দেহে গফরগাঁওয়ে কুপিয়ে জখম, ময়মনসিংহে বাস বন্ধ দুর্ভোগে মানুষ, ময়মনসিংহে গণসমাবেশে বাঁশে পতাকা বেঁধে বিএনপি কর্মীরা, ময়মনসিংহে বিএনপির গণসমাবেশ, বাঁশের লাঠিসহ আটক ৪, সংঘাত এড়াতে নগরীতে ৬ শতাধিক পুলিশ, বাধা পেরিয়ে সমাবেশস্থলে বিএনপি নেতাকর্মীরা।
শনিবারের সমাবেশের মধ্য দিয়ে বিএনপি প্রাথমিক বাধা উতরে গেছে ধরে নেওয়া যায়। গত কয়েক বছরে এভাবে মাঠে সভা-সমাবেশ করাই তো দলটির জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল! আমরা জানি, একটি গণতান্ত্রিক দেশে সভা-সমাবেশ রাজনৈতিক অধিকারের অংশ। কিন্তু আমাদের এখানে দেখা যায়, সভা আয়োজনের শুরু থেকেই চলে আসে নানা বাধা-বিপত্তি। প্রথমে সেটা শুরু হয় সমাবেশস্থল বরাদ্দ পাওয়ার মধ্য দিয়ে। দেখা যায়, যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সে সরকারের পক্ষের বা জোটের যে কোনো সভা-সমাবেশের অনুমতি সহজেই পাওয়া যায়। যেন 'চাহিবা মাত্র দিতে বাধ্য থাকিবে।' অপরদিকে, বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে অনেক সময় সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সভার আয়োজনের অনুমতি পেতেও হাইকোর্টের অনুমতি নিতে হয়। সেই বিচারে বিএনপির ময়মনসিংহ বিভাগীয় সমাবেশের অনুমতি পাওয়া থেকে শুরু করে যা কিছু ঘটেছে তা প্রায় অনুমেয়ই ছিল।
বিএনপির দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল তাদের দলীয় কর্মসূচির সঙ্গে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করা। ময়মনসিংহে খোদ আওয়ামী লীগই যেন কাজটি সহজ করে দিয়েছে। সমাবেশের দিন ময়মনসিংহজুড়ে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট চলেছে ক্ষমতাসীন দলের ইঙ্গিতে। ফলে ময়মনসিংহসহ আশপাশের জেলার বাসিন্দাদের পড়তে হয়েছে অবর্ণনীয় ভোগান্তির মুখে। শুক্রবার সকাল থেকে শুরু করে শনিবার সারাদিন যেভাবে গণপরিবহন বন্ধ করে রাখা হলো এবং এর ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হলো এর কী ব্যাখ্যা দেবে আওয়ামী লীগ? এর দায় যেমন ক্ষমতাসীন দল তথা সরকার এড়াতে পারে না, তেমনই এর 'সুফল' যে বিএনপির ঘরে গেছে, সেটাও অস্বীকারের অবকাশ নেই।
আওয়ামী লীগের কর্মীরা মোটরসাইকেল ও লাঠি নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় মহড়া দিয়েছে দিনভর- এমন ছবি দেখা গেছে সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আবার এই গণসমাবেশে যোগ দিতে আসা বিএনপির বেশ কয়েকটি মিছিলে অংশ নেওয়া কর্মীদের দেখা গেছে বাঁশের মাথায় জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করতে। এমন অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাও ছিল উল্লেখযোগ্য হারে। এর আগে ঢাকার পল্লবীর সমাবেশে প্রথম বাঁশের সঙ্গে পতাকা নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা অংশ নিয়েছিলেন। সেই সময়ে মিছিলে বাঁশ নিয়ে আসায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, বিএনপি সহিংসতা করতে চায়। জবাবে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, আওয়ামী লীগের হামলা থেকে রক্ষা পেতে ও আত্মরক্ষার্থে তারা বাঁশ হাতে নিয়েছে।
ময়মনসিংহ সমাবেশে তৃতীয় আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। এত বাধা পেরিয়ে বিএনপি নেতাকর্মী যেমন উজ্জীবিত হয়েছেন, বাধা দিয়েও শেষ পর্যন্ত জনসমাগম ঠেকাতে না পেরে নৈতিকভাবে হেরে গেছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মী। এর উত্তর খুঁজতে দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ময়মনসিংহে বিএনপির সমাবেশ ঘিরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী লাঠি হাতে নিয়ে মহড়া দিয়েছেন, শহরের রেলস্টেশন এলাকায় বিএনপির মিছিলে হামলা করেছেন। যদিও বিএনপি নেতাকর্মীর পাল্টা ধাওয়ার মুখে পিছু হটেছে আওয়ামী লীগ।
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছিল যে, আগামী সাধারণ নির্বাচন কোনো রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নয়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে। তবে সংবিধান অনুযায়ী তা করা সম্ভব নয় বলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার তা তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির বর্তমানে যে বিভাগীয় গণসমাবেশ কর্মসূচি তা একটি নির্দিষ্ট দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে।
বিএনপি ময়মনসিংহ ছাড়াও চট্টগ্রামেও বিভাগীয় সমাবেশ সম্পন্ন করেছে। তাতে দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণও দেখা গেছে। এখন দলীয় নেতাকর্মীর বাইরে সাধারণ নাগরিকও তাদের দাবিগুলোর সঙ্গে কতটা একাত্মতা পোষণ করতে পারে, তা দেখতে হলে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
এহ্সান মাহমুদ: সহসম্পাদক, সমকাল
মন্তব্য করুন