পরিকল্পিত নগরায়ণের জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তথা রাজউক প্রথমবারের মতো বাংলা ভাষায় 'ঢাকা মহানগরীর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-২০৩৫)' বা ড্যাপ প্রণয়ন ও কার্যকরের করার সিদ্ধান্ত নেয়। এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব বিন্যাস, নগরজীবন রেখা, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধার মানদণ্ড প্রণয়ন, ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন ও উন্নয়ন স্বত্ব বিনিময়, হকার ব্যবস্থাপনা নির্দেশনা, নতুন ও অবহেলিত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্তি, ভূ-প্রাকৃতিক শ্রেণিবিন্যাসসহ ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং ভূমির পুনর্বিন্যাস ও পুনঃউন্নয়ন বিষয়ে গুরুত্ব আরোপের কারণে পরিকল্পনাটি যুগোপযোগী ও জনবান্ধব হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে; যা সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু যে খসড়া 'ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (২০১৬-২০৩৫)' ভিত্তি করে ড্যাপ তৈরি হয়েছে, সেটা অনুমোদন ছাড়া শুধু 'ড্যাপ' গেজেটভুক্ত করা হয়। এটি আইনগত দিক থেকে গুরুতর ব্যত্যয় এবং এতে ড্যাপের কাঙ্ক্ষিত বাস্তবায়ন ব্যাহত হতে পারে।

খসড়া ড্যাপ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এর প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। কিছু প্রস্তাবনার বিচ্যুতি অনুধাবন করে সেগুলো জনবান্ধব করার লক্ষ্যে গত দুই বছরব্যাপী যথাযথ অংশীজনদের নিয়ে নিয়মিত কর্মশালা আয়োজিত হয়েছে। কর্মশালা থেকে প্রাপ্ত পর্যালোচনা সাপেক্ষে রাজউকের ড্যাপ প্রণয়নকারী দল এবং অংশীজনের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু গেজেটকৃত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় সেই সমঝোতা স্মারকের বেশ কিছু প্রস্তাবনার অবজ্ঞা ও ব্যত্যয় প্রকটভাবে পরিলক্ষিত। প্রস্তাবনাগুলো বিশদ আলোচনার অবকাশ রাখে।

ক. জনসংখ্যা

ড্যাপ পরিকল্পনায় ২০৩৫ সাল পর্যন্ত প্রক্ষেপিত জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ এবং মেট্রোপলিটন এলাকায় সামগ্রিক জনঘনত্ব ধরা হয়েছে প্রতি হেক্টরে ৩০০। পাশাপাশি ঢাকা মহানগরীতে আবাসযোগ্য মোট ৩৪৬টি কমিউনিটি ব্লকের কাঙ্ক্ষিত গড় জনঘনত্ব ধরা হয়েছে একরপ্রতি ১৫০ থেকে ২৫০। অথচ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন মেয়াদে ড্যাপ আওতাধীন এলাকার সুপারিশকৃত গড় ঘনত্ব অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত মোট জনসংখ্যা কিংবা এ শহরের মোট জনসংখ্যা বহনক্ষমতা কত, তার উল্লেখ নেই। যদিও রাজউকের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, সুপারিশকৃত গড় ঘনত্ব অনুযায়ী রাজউক এলাকায় পরিণত অবস্থায় সর্বোচ্চ প্রায় ৬ কোটি ৩৬ লাখ মানুষ ধারণ করা সম্ভব হবে। এর কোনো ব্যাখ্যা গেজেটকৃত প্রতিবেদনে নেই।

খ. ভূমি ব্যবহার

পরিকল্পনাধীন (১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার বা ৩,৭৭,৭০৪ একর) এলাকায় মোট ১৩ ধরনের ভূমি ব্যবহারের প্রস্তাবনা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- মিশ্র ব্যবহার (আবাসিকপ্রধান) ৩২ দশমিক ৫২ শতাংশ; আবাসিক এলাকা ৪ দশমিক ৩৫ শতাংশ; মিশ্র ব্যবহার (আবাসিক-বাণিজ্যিক) শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ; মিশ্র ব্যবহার (বাণিজ্যিকপ্রধান) ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ; মিশ্র ব্যবহার (শিল্পপ্রধান) ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ ভূমি। কৃষি এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ২৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ ভূমি।

অন্যদিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় অঞ্চলে (৩০৪ দশমিক ৭৪ বর্গকিলোমিটার বা ৭৫,৩০৩ দশমিক ৭১ একর) মিশ্র ভূমি ব্যবহারের মধ্যে ৩৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ১৫ দশমিক ৭৪, ২ দশমিক ৩৩, ২ দশমিক ২৮ ও ১ দশমিক ৩২ শতাংশ জমি যথাক্রমে মিশ্র ব্যবহার এলাকা (আবাসিকপ্রধান), আবাসিক এলাকা, মিশ্র ব্যবহার এলাকা (আবাসিক-বাণিজ্যিক), মিশ্র ব্যবহার এলাকা (বাণিজ্যিকপ্রধান), মিশ্র ব্যবহার এলাকা (শিল্পপ্রধান) এবং কৃষি এলাকা হিসেবে ১ দশমিক ৮৮ শতাংশ বরাদ্দ করা আছে।

উল্লেখ্য, আবাসিক ও মিশ্র ব্যবহার এলাকা হিসেবে প্রস্তাবিত এলাকাগুলোয় শর্তসাপেক্ষে (সড়কের প্রশস্ততার ভিত্তিতে) অ-আবাসিক ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে; যা মূলত মোট আবাসিক হিসেবে ব্যবহূত জায়গা আরও সংকুচিত করবে।

গ. আবাসন, এফএআর ও জনঘনত্ব

ঢাকা মহানগরীতে আবাসন সংকট প্রকটভাবে বিদ্যমান। ঢাকার প্রায় ৬৪ শতাংশ ভূমি ব্যবহার করে নগরের মধ্যবিত্ত আয়ের (প্রায় ৩০ শতাংশ) মানুষ। সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা, যারা মূলত নিম্ন আয়ের মানুষ (প্রায় ৩৭ শতাংশ), তাদের ভূমি ব্যবহারের পরিমাণ মাত্র ১১ শতাংশ। অন্যদিকে স্বল্পসংখ্যক উচ্চবিত্ত (প্রায় ২ শতাংশ) ব্যবহার করেন প্রায় ১৫ শতাংশ ভূমি। এখান থেকে এটি স্পষ্ট, আবাসনের চাহিদা সবচেয়ে বেশি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। অথচ এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রায় ৭৮ শতাংশ এবং নিম্নবিত্ত মানুষের প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষ আবাসন সংস্থানের সামর্থ্য রাখে না। পাশাপাশি ২০১৮ থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত চাহিদা অনুসারে আবাসনের ঘাটতিতে রয়েছে প্রায় ৪৩ লাখ। তাই আবাসন সমস্যা নিরসনে ড্যাপ পরিকল্পনায় সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রত্যাশিত ছিল। পরিকল্পনার মেয়াদে অর্থাৎ ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকা মহানগর অঞ্চলে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য ১ লাখ আবাসিক ইউনিট নির্মাণ করার তাগিদসহ মোট ৫৭টি সাশ্রয়ী আবাসনের স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। অথচ শহরে বসবাসকারী মধ্যম মধ্যবিত্তের আবাসন সংকট সমাধানে কোনো রূপরেখা পরিকল্পনায় উল্লেখ নেই।

এক্ষেত্রে 'ফ্লোর এরিয়া রেশিয়ো' তথা 'এএফআর' ধারণাটি প্রাসঙ্গিক। জমির পরিমাণের অনুপাতে মোট কতটুকু ক্ষেত্রফলের ভবন নির্মাণ করা যাবে, এটি তার অনুপাত। এর সঙ্গে সম্পর্কিত 'সর্বোচ্চ ভূমি আচ্ছাদন' বা 'মেক্সিমাম গ্রাউন্ড কাভারেজ' তথা এমজিসি। একটি স্থাপনা তার জমিটুকুর কতখানি অধিকার করে আছে, এটি দিয়ে তা প্রকাশ করা হয়। জমির আয়তনভেদে এমজিসির মান সাধারণত ৪০-৬০ শতাংশের মধ্যে থাকে। একটি জমিতে কতটুকু নির্মাণ করা যাবে তা সাধারণভাবে এফএআর ও এমজিসি গুণফলেই নির্ধারিত হয়।

ড্যাপে আবাসিক হিসেবে নির্ধারিত বাসযোগ্য এলাকায় যে জনঘনত্ব প্রস্তাব করা হয়েছে, তা সেসব এলাকার বর্তমান জনঘনত্ব বা ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রক্ষেপিত জনঘনত্ব থেকেও কম। যেমন ড্যাপের উপ-অঞ্চল ১০ (মোহাম্মদপুর/শ্যামলী) এলাকায় ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রাক্কলিত জনসংখ্যার ঘনত্ব একরপ্রতি ৩২৯ জন। কিন্তু প্রস্তাবিত কাঙ্ক্ষিত সর্বোচ্চ জনঘনত্ব ধরা হয়েছে একরপ্রতি ২৫০ জন। অর্থাৎ একরপ্রতি অন্তত ৭৯ জনের আবাসন কীভাবে হবে তা এখানে নিশ্চিত নয়। ড্যাপের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, আবাসিক ও মিশ্র ব্যবহার এলাকায় শর্তসাপেক্ষে অ-আবাসিক ব্যবহার অনুমোদনের কারণে আনুপাতিক হারে আবাসিক এলাকা সংকুচিত হবে।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য পর্যাপ্ত, নিরাপদ ও মূল্যসাশ্রয়ী আবাসন এবং মৌলিক সুবিধায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করাসহ বস্তির উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্কের নবম বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত 'টেকসই ও সাশ্রয়ী আবাসন' বিষয়ক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন- একটি নিরাপদ ও উপযুক্ত বাসস্থান প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। তাহলে আবাসন সংকটের আশঙ্কা উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে প্রণীত এই পরিকল্পনা কতটুকু জনবান্ধব বা জনস্বার্থ রক্ষার্থে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সে প্রশ্নেরই অবতারণা হয়।

ঘ. জনঘনত্ব বিন্যাস ও এফএআর অসাম্য

প্রস্তাবিত ড্যাপে এলাকাভিত্তিক এফএআর নির্ধারণেও লক্ষণীয় অসাম্য রয়েছে। পরিকল্পিত এলাকায় উন্নত অবকাঠামোর ভিত্তিতে বেশি এফএআর প্রদান, অন্যদিকে স্বতঃস্ম্ফূূর্তভাবে গড়ে ওঠা এলাকায় উন্নত অবকাঠামো নেই বিধায় কম এফএআর দেওয়া হয়েছে। এতে কম এফএআরপ্রাপ্ত এলাকায় ২০০৮ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করলে যত তলা ভবন তৈরি করা যেত, তার চেয়ে দুই থেকে তিন বা ক্ষেত্রবিশেষে চার থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত হ্রাস ঘটবে। বাস্তবিক অর্থে উচ্চতা কখনও উন্নয়নের অন্তরায় নয়; বরং সঠিক নিয়মে এবং পরিকল্পিত নকশার মাধ্যমে এই ঢাকা শহরের স্থাপনাগুলো দালান থেকে মানবিক আবাসস্থলে রূপান্তর করার পাশাপাশি পুরো শহরকে সংবেদনশীল ও বাসযোগ্য করে তোলাই সংশ্নিষ্ট সবার দায়িত্ব। এ জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং সেবা প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

ড্যাপের মূল উদ্দেশ্যগুলোর একটি জনসংখ্যার বিকেন্দ্রীকরণ। কিন্তু ঢাকার বর্ধিত অঞ্চল, অর্থাৎ ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের নতুন ওয়ার্ডগুলোয় এবং বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাধীন ঢাকার বহিস্থ অঞ্চল, অর্থাৎ গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রূপগঞ্জ, কালিগঞ্জ, সাভার এবং কেরানীগঞ্জের দু-তিনটি এলাকা ছাড়া প্রায় সব এলাকাতেই কাঙ্ক্ষিত জনঘনত্ব কম নির্ধারণ সাপেক্ষে এলাকাভিত্তিক এফএআরও কম নির্ধারণ করা হয়েছে। ড্যাপ যখন বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলছে তখন কেন্দ্রীয় ঢাকার অত্যধিক জনসংখ্যার বিকেন্দ্রীকরণ এই শিল্পাঞ্চলগুলোয় আবাসন গড়ে ওঠার পথ সংকুচিত করার মাধ্যমে কীভাবে সম্ভব- তা বোধগম্য নয়।

২০১৮ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, বাস্তুচ্যুত বাংলাদেশির সংখ্যা ২০৫০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৩৩ লাখে পৌঁছতে পারে। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (আরএমএমআরইউ) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে গ্রাম থেকে আসা অভিবাসীর প্রতি পাঁচজনের মধ্যে তিনজন (৫৯ দশমিক ২ শতাংশ) ঢাকায় আশ্রয় নেয়। ড্যাপ প্রণীত নির্মাণ অধিকারের অসামঞ্জস্যের ফলে এই বিপুল মানুষ প্রকট আবাসন সংকটে পড়তে পারে। উল্টোদিকে ড্যাপে শহরে জনসংখ্যার বিকেন্দ্রীকরণের সুস্পষ্ট রূপরেখা ও প্রস্তাবনাও অনুপস্থিত।

ঙ. ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন

ড্যাপের ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের প্রস্তাবনা এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্লকভিত্তিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করার কৌশল প্রশংসনীয় হলেও, এ ক্ষেত্রে যে প্রণোদনার প্রস্তাব রাখা হয়েছে তা পর্যাপ্ত নয়। এ ছাড়া সামাজিকভাবে ঢাকার মানুষ অংশীদারিত্বের মাধ্যমে প্লট একত্রীকরণে উৎসাহী নয়। খুবই অল্প এই প্রণোদনা নিয়ে সাধারণ মানুষ রাতারাতি ব্লকভিত্তিক উন্নয়নে উৎসাহী হয়ে উঠবে- এমন ভাবনা পরাবাস্তবিক। যথাযথ সমীক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে ড্যাপ যদি উৎসাহজনক প্রণোদনার সুযোগ করে, তবে সাধারণ মানুষই ব্লকভিত্তিক উন্নয়নে এগিয়ে আসবে।

চ. বন্যাপ্রবাহ এলাকা ও কৃষিজমি

প্রস্তাবিত ড্যাপে ২০০০ সালের ৩৬ নং আইনের (মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন) ব্যত্যয় করে বন্যাপ্রবাহ এলাকাকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এলাকা হিসেবে শ্রেণিবিভক্ত করে শর্তসাপেক্ষে স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বন্যাপ্রবাহ এলাকাকে 'মুখ্য জলস্রোত', 'সাধারণ জলস্রোত ও সাধারণ প্লাবনভূমি' শ্রেণিতে বিভক্ত করে শর্তসাপেক্ষে স্থাপনা অনুমোদনের প্রস্তাবনা, বিদ্যমান আইন ও আদালতের আদেশের সুস্পষ্ট ব্যত্যয় এবং জনস্বার্থ পরিপন্থি। উল্লেখ্য, ড্যাপ ২০১০-এ সংরক্ষিত প্রায় ২১ শতাংশ বন্যাপ্রবাহ এলাকাকে ড্যাপ ২০২২-এ মাত্র ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ মুখ্য জলস্রোত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে সংরক্ষণের আওতায় প্রস্তাবিত হয়েছে। এতে বন্যাপ্রবাহ এলাকা ধ্বংস হয়ে নগরবন্যা, জলাবদ্ধতা ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের আশঙ্কাজনক হ্রাসে ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকা শহর আরও বিপজ্জনক হয়ে পড়বে।

পাশাপাশি পরিকল্পনাধীন এলাকার মোট ২৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ কৃষিজমিতেও 'শর্তসাপেক্ষে' নির্মাণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব এলাকায় ইকো রিসোর্ট, বাংলো, ভিলা, একক পরিবারের বাসস্থান, গ্রামীণ ভিটা এবং সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় নির্মাণ অনুমোদনের প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া শর্তসাপেক্ষে এসব এলাকায় বহু পরিবারের ইউনিট, হাসপাতাল, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র বা বর্জ্য ট্রান্সফার স্টেশন, গো-খামার, হাঁস-মুরগির খামার, আটা-চাল-হলুদ-মরিচ ভাঙানোর কল, লবণ প্রস্তুতকরণ কারখানা এবং স্বয়ংক্রিয় চালকলের মতো স্থাপনা নির্মাণের প্রস্তাবনা রয়েছে। এ ধরনের যথেচ্ছ ব্যবহার ঢাকার প্রান্তীয় অঞ্চলের কৃষিজমি ধ্বংসের পথে ঠেলে দেবে।

ছ. ব্লু নেটওয়ার্ক

ড্যাপে নৌপথের সমন্বয়ে 'ব্লু নেটওয়ার্ক' প্রতিষ্ঠার যে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে তা প্রশংসনীয়। কিন্তু শুধু নৌপথ স্থাপন ও কালভার্টকে ব্রিজ দ্বারা প্রতিস্থাপন করলেই ব্লু নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা হবে না। ঢাকায় হারিয়ে যেতে বসা অভ্যন্তরীণ খালগুলো সমন্বিতভাবে পুনরুদ্ধার ও সংস্কারের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। এ ছাড়া নদী টাস্কফোর্স তালিকাভুক্ত ঢাকার সব খালসহ (যা বর্তমানে ২৬টিতে এসে ঠেকেছে) পুরো পরিকল্পনা এলাকায় চিহ্নিত খালগুলোর পূর্ণাঙ্গ তালিকা ড্যাপ পরিকল্পনা প্রতিবেদনে অনুপস্থিত। তাই উপযুক্ত তালিকায় চিহ্নিত খালগুলোর আন্তঃসংযোগ স্থাপনের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা ছাড়া 'ব্লু নেটওয়ার্ক' প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

জ. অননুমোদিত ও অবৈধ স্থাপনা বৈধকরণ

ড্যাপে অবৈধ স্থাপনাগুলোর শ্রেণিবিভাজন সাপেক্ষে সেই অনুযায়ী জরিমানার বিধান রেখে অবৈধ অংশ সংস্কার বা অপসারণ নিশ্চিতকরণে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা ছাড়া বৈধকরণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইমারত নির্মাণ আইন ১৯৫২-এর প্রয়োজনীয় পরিমার্জনের প্রস্তাবনায় ক্ষেত্রবিশেষে কাঠামোগত সংশোধন/অপসারণ/পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। যেখানে অবৈধ ভবন বৈধকরণের ক্ষেত্রে ইমারত নির্মাণ আইনের কঠোর প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার দাবি ছিল, সেখানে এ ধরনের প্রস্তাবনা অবৈধ নির্মাণ, বিশেষ করে কম এফএআরপ্রাপ্ত এলাকাগুলোয় অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকেই পরোক্ষভাবে উৎসাহ দেবে ফলে ড্যাপের মূল লক্ষ্য প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

ঝ. বাস্তবায়ন পরিকল্পনা

ড্যাপে অবকাঠামো প্রদানে যে 'মাল্টিসেক্টরাল ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম' তথা এমএসআইপি-এর আওতায় যে বাস্তবায়ন প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে, সেটাও বাস্তবানুগভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। বাস্তবায়ন পরিকল্পনায় প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যেই ৬২৭টি বিদ্যালয়, ২৮৭টি হাসপাতাল, নগর জীবনরেখার অন্তর্ভুক্ত ২৩টি খাল ও ১৩৯ কিলোমিটার সড়ক, বিভিন্ন ধরনের পার্ক (আঞ্চলিক, জলকেন্দ্রিক, ইকো পার্কসহ অন্যান্য পার্ক), ৫০০টি পুকুর, ৫৭৪ কিলোমিটার জলপথ বা ব্লু নেটওয়ার্ক স্থাপনসহ বেশ কিছু অবকাঠামোগত প্রকল্প, পরিকল্পনা, জমি অধিগ্রহণ ও নির্মাণ সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রস্তাবনা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শুধু ৬২৭টি বিদ্যালয় প্রকল্পের ক্ষেত্রে ২৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রয়োজন হবে উল্লেখ করা হলেও, কীভাবে এ ধরনের বাজেটের সংস্থান হবে তা সুস্পষ্ট করা হয়নি। এসব উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান, নির্দেশিত সংস্থার দায়বদ্ধতা ও বাস্তবায়ন সক্ষমতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাও অনুপস্থিত।

ঞ. রাজউক পুনর্গঠন

ড্যাপে নগর বিশৃঙ্খলার জন্য উচ্চতর এফএআরকে দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর জন্য দায়ী অবৈধ নির্মাণের সুযোগ এবং রাজউকের তদারকির অভাব। রাজউকের এলাকায় ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত যত ভবন নির্মাণ হয়েছে, তার ৯৫ শতাংশের বেশি অবৈধ এবং অনুমোদনবিহীন। ঢাকা একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যময় এবং ক্রমপরিবর্তনশীল শহর। এই শহরের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের গুরুদায়িত্ব যে পালন করবে, জনমানুষের কাছে তার অবশ্যই দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। এ জন্য দ্রুতই রাজউককে পেশাজীবী নেতৃত্বে পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস করে কিংবা পেশাজীবীনির্ভর একটি ভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে এ মহাপরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

চ. অন্যান্য

ড্যাপ প্রণয়নে সম্পৃক্ত বিভিন্ন কার্যপত্র, যেমন- জনঘনত্ব জোনিং, পরিবেশগত বিষয়, পরিবহন সমস্যা, শহরের ইমারত নির্মাণধারার পরিবর্তন ও অবকাঠামো উপযুক্ততা বিশ্নেষণ, রাস্তার প্রশস্ততা-সংশ্নিষ্ট অনুমোদনযোগ্য এফএআর সূচক ইত্যাদি কীভাবে নির্ণয় করা হয়েছে তা এখনও প্রকাশ করা হয়নি। এতে ড্যাপে প্রস্তাবিত বিভিন্ন কার্যক্রম ও পদ্ধতি সম্পর্ক ধোঁয়াশা রয়ে যায়। এ ছাড়া ড্যাপের সময়কাল ২০১৬ থেকে ২০৩৫ হলেও তপশিলকৃত ড্যাপে মেয়াদকাল ২০২২ থেকে ২০৩৫ সাল। তাই ২০২২ থেকে গত ছয় বছরে প্রাপ্ত এবং নিরীক্ষিত তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে ২০২২ থেকে ভবিষ্যৎ ১৩ বছরের পরিকল্পনা করার পর মেয়াদ নির্ধারণে বিগত বছরগুলোকে উপেক্ষা করার ব্যাপারটিও প্রশ্নের উদ্রেক করে।

ছ. সুপারিশ

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মনে রাখতে হবে, ঢাকার আবাসনের মূল চাহিদার কারণ কর্মসংস্থান। তাই কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমেই প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। কর্মসংস্থানের বিকেন্দ্রীকরণের ওপর জোর না দিয়ে আবাসন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করে বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা মানুষকে আশ্রয়হীনতার দিকে ঠেলে দেবে। মূল রোগের চিকিৎসা না করে, তার উপসর্গকে নিরাময়ের চেষ্টা রোগীর মৃত্যুই অবধারিত করবে। ড্যাপে প্রস্তাবিত আকস্মিক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা শুধু বিশৃঙ্খলা, অসাম্য, অন্যায্যতা এবং বাস্তুহীনতা তৈরি করার দিকে পথপ্রদর্শন ছাড়া আর কিছুই অর্জন করবে না। এ কারণে অংশীজনের দাবি হচ্ছে- ১. বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ক) প্রাক্কলিত জনসংখ্যা, খ) প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রাবল্য এবং গ) সাম্যের ভিত্তিতে সবার আবাসন নিশ্চিত করেই এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব ও এফএআর নির্ধারণ করতে হবে।

২. কৃষিজমিতে শর্তসাপেক্ষে উন্নয়ন বা ভূমি ব্যবহার পরিবর্তনের সুযোগ সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে।

৩. বন্যাপ্রবাহ অঞ্চলে কোনো ধরনের নির্মাণ সুযোগ রহিত করে জলাধার আইন অনুযায়ী তার পূর্ণ সংরক্ষণ করতে হবে এবং শ্রেণিবিভক্তির মাধ্যমে এসব অঞ্চলে শর্তসাপেক্ষে নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি ওইসব অঞ্চল নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সংরক্ষণের সুস্পষ্ট প্রস্তাবনা থাকতে হবে।

৪. নদী কমিশন চিহ্নিত সব খালসহ সমীক্ষায় প্রাপ্ত খালগুলোর পূর্ণাঙ্গ তালিকা পরিকল্পনা প্রতিবেদনে সংযুক্ত করে সব জলাধার সংরক্ষণ এবং এর উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে 'জিরো টলারেন্স' নীতিমালা নিশ্চিত করতে হবে।

৫. সর্বোপরি ড্যাপে প্রস্তাবিত উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থানের উৎস, সংশ্নিষ্ট উদ্যোগী সংস্থার দায়বদ্ধতা ও বাস্তবায়ন সক্ষমতা নিশ্চিত সুস্পষ্ট করা উচিত। ড্যাপ বাস্তবায়নে রাজউকের কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে প্রশাসন নির্ভরতা থেকে পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও জনপ্রতিনিধির কর্তৃত্বে নিয়ে আসতে হবে এবং অবশ্যই কারিগরি দক্ষ সংগঠনে রূপান্তর করতে হবে। একই সঙ্গে রাজউককে সব ধরনের উন্নয়নের কার্যক্রম থেকে নিবৃত হয়ে শুধু উন্নয়ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

৬. সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় ড্যাপের প্রস্তাবনাগুলোর প্রভাব বিশ্নেষণসাপেক্ষে এর সংশোধন রাজউককেই নিশ্চিত করতে হবে। যূথবদ্ধ অভিভাবকত্বই ড্যাপ বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান কার্যক্রম এবং এর মাধ্যমেই একটি সুস্থ, সুষম, সুস্পষ্ট, সুন্দর এবং সবার জন্য গ্রহণযোগ্য একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন নিশ্চিত করা উচিত।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন: সভাপতি, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট; স্থপতি ইকবাল হাবিব :যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা); সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান:প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা); স্থপতি কাজী গোলাম নাসির :সাবেক প্রধান স্থপতি, স্থাপত্য অধিদপ্তর, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়