- মতামত
- ইউএনওর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সার্ভিসের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ
জনপ্রশাসন
ইউএনওর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সার্ভিসের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ

বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার ইউএনও মেহরুবা ইসলাম চৈক্ষ্যং আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ফুটবল খেলার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে খেলোয়াড় ও জনতার উপস্থিতিতে টুর্নামেন্টের টফি আছড়ে ভেঙেছেন। খেলা শেষে ইউএনও বক্তৃতা দেওয়ার সময় খেলার ফলাফল নিয়ে কিছু স্থানীয় লোক অসন্তোষ প্রকাশ করলে ক্ষেপে গিয়ে বলেন, 'আপনারা যতদিন পর্যন্ত সহনশীল না হতে পারবেন, ততদিন ট্রফিগুলো আমানত হিসেবে থাকবে। আরেকটি ম্যাচ হলে তারপর দেব।'
পারিবারিক বিষয় নিয়ে এলজিইডির নৈশপ্রহরী আলমগীর হোসেন শেখের স্ত্রী বগুড়া সদরের ইউএনও সমর কুমার পালের কাছে মৌখিক নালিশ দিলে ইউএনও আনসার বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে আলমগীরকে ধরে এনে নিজ হাতে প্রহার করে হাত-পা ভেঙে দিয়েছেন। গত ২৬ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের এসিল্যান্ড অমিত দত্ত তাঁর অফিসের দুই কর্মচারীকে কাজে গাফিলতির জন্য জুতাপেটা করেছেন। কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারীর ইউএনও দীপক দেব শর্মার দায়িত্বহীনতার জন্য এসএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডকে পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে। ৯ মে সকাল সাড়ে ১০টায় নাটোরের সিংড়া উপজেলার নিংগইন এলাকায় জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার ইউএনওর গাড়ি এক সাংবাদিক ও শিক্ষককে চাপা দেয়। সে সময় গাড়িতে তাঁর স্ত্রী প্রভাষক মানসী দত্ত ওরফে মৌমিতা ছিলেন। ইউএনও দাবি করেন, তাঁর সরকারি গাড়িটি সিংড়ায় জ্বালানি তেল আনতে যাচ্ছিল।
ঘটনাগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়, আলীকদমের ইউএনও যে আচরণ করেছেন সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। পুরস্কারের ট্রফি শুধু ট্রফি নয়, এটি উভয় দল ও এলাকার মানসম্মানের প্রতীক। ট্রফি ভেঙে ফেলার অর্থ খেলোয়াড় ও জনসাধারণকে চরমভাবে অপমান করা। বিষয়টি কোনোভাবেই ছোট করে দেখা উচিত হবে না। বগুড়া সদরের ইউএনও এলজিইডির নৈশপ্রহরীকে মারধর ও টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের এসিল্যান্ড সহকর্মীদের জুতাপেটা করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। লাঠি দিয়ে আঘাত বা জুতাপেটা করে জখম করা দঃবিঃ ৩২৩/৩২৫ ধারার অপরাধ। এ ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাকে শুধু বদলি বা তদন্ত কমিটি গঠন পর্যাপ্ত নয় বলে আমি মনে করি।
কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে এসএসসি পরীক্ষা গ্রহণের সব দায়-দায়িত্ব ইউএনওর ওপর অর্পণ করা হয়ে থাকে। থানার নিরাপত্তা হেফাজতে প্রশ্নপত্র রাখা, ট্রাঙ্কের সিলগালা ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করা, সঠিক সেটে পরীক্ষা নেওয়া, থানা থেকে প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে পৌঁছানো, দুর্নীতিমুক্তভাবে পরীক্ষা অনুষ্ঠান ইত্যাদি সব দায়িত্ব ইউএনওর ওপর বর্তায়। প্রায়ই শোনা যায়, প্রশ্নপত্রের ট্রাঙ্ক খোলার সময় ইউএনও থানায় না গিয়ে অন্য একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেন। পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানের চেয়ে বড় দায়িত্ব আর কী হতে পারে? তাঁর দায়িত্বহীনতার সুযোগে কেন্দ্র সচিব প্রশ্নপত্রের ট্রাঙ্ক খোলার সময় পরবর্তী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র লুকিয়ে বাইরে নিয়ে ফাঁস করেছেন। এতে পরীক্ষার্থীদের কত হয়রানি হতে হয়েছে, তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। পুনরায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, ছাপানো, জেলা ও উপজেলায় পৌঁছানো ইত্যাদি কাজে রাষ্ট্রকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়।
প্রশাসন সার্ভিস একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। ব্রিটিশ আমলে এ সার্ভিসটি ইংরেজ বেনিয়া ও দেশীয় জমিদারদের স্বার্থরক্ষার জন্য সৃষ্টি হলেও কালের বিবর্তনে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে বলে মনে হয়। মুক্তিযুদ্ধে এ সার্ভিসের অনেক কর্মকর্তা নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। অনেকে ট্রেজারিতে রক্ষিত অস্ত্র ও অর্থ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ করে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে জনগণকে উৎসাহিত করেছেন। জাতীয় দুর্যোগসহ দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এ সার্ভিসের কর্মকর্তারা কাজ করে থাকেন। যখন দেখি, পুত্র-কন্যারা রাস্তার পাশে রোগাক্রান্ত মাকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে গেলে একজন ইউএনও পরম মমতায় রাস্তা থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে দেন, তখন গর্বে বুক ভরে যায়। মাঠ পর্যায়ে কর্মরত প্রশাসন সার্ভিসের কর্মকর্তাদের ভালো কাজের এ রকম হাজারটি উদাহরণ দেওয়া যাবে। কিন্তু কিছু কর্মকর্তার আচরণে সার্ভিসের মানমর্যাদা আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ইউএনও মাঠ প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কর্মকর্তা। আজ যাঁরা ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁরা ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবেন। ভবিষ্যতে মেগা প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, মনিটরিং ইত্যাদি কাজ করতে হবে। মাঠ পর্যায়ে তাঁদের পাঠানোর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, মাঠের অভিজ্ঞতা যাতে ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে পারেন। তাঁরা যদি নৈতিকতা বিবর্জিত কাজ, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ-দুর্নীতি, দায়িত্বহীন আচরণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হন তবে তাঁদের দ্বারা ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে ইউএনওরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তুচ্ছ বিষয়ে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এসব কারণে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হয়, যা মোটেই কাম্য হতে পারে না।
কর্মকর্তাদের অনুধাবন করা উচিত, ক্ষমতা কখনও চিরস্থায়ী নয়। বঙ্গবন্ধুর কথায় বলতে হয়, 'আপনি চাকরি করেন আপনার মাইনে দেন ওই গরিব কৃষক। আপনার মাইনে দেন ওই গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন। ওদের ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই প্রকৃত মালিক। ওদের টাকায়ই আপনাদের সংসার চলে।'
শেখ ইউসুফ হারুন: নির্বাহী চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়
মন্তব্য করুন