- মতামত
- ক্ষুধা ও ক্ষোভ
ক্ষুধা ও ক্ষোভ
ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল লইয়া রাজধানীর মিরপুরে পুলিশের সহিত উহার চালকদের যেইরূপ সংঘর্ষ ঘটিয়া গেল তাহা কর্তৃপক্ষের জন্য সতর্কবার্তা বটে! ক্ষুধার জ্বালা ও ক্ষোভের জ্বালানির মধ্যে যে স্বচ্ছ যবনিকা রহিয়াছে, উহা ভাঙিয়া গেলে পরিস্থিতি কী হইতে পারে, মিরপুরে যেন তাহার খণ্ডচিত্র প্রদর্শিত হইল। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানা গিয়াছে শুক্রবার সকালে পুলিশ ব্যাটারিচালিত রিকশাবিরোধী অভিযানে নামিয়া দুইটা রিকশা আটক করে; ইহাতে ক্ষুব্ধ হইয়া সংঘবদ্ধ রিকশাচালকেরা এলাকার অন্তত সাতটা পুলিশ বক্সে হামলা চালাইয়াছেন এবং সাত পুলিশ সদস্যকে আহত করিয়াছেন, যাঁহাদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। বোঝা যাইতেছে, রিকশাচালকদের ঐ হামলার জন্য মিরপুরের পুলিশ প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু দরিদ্র, নিরীহ এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী রিকশাচালকেরা এমনভাবে ক্ষেপিয়া গিয়াছেন কেন?
প্রতিবেদনেই বলা হইয়াছে, দিনের পর দিন পুলিশের হয়রানি ও চাঁদাবাজিতে ঐ রিকশাচালকেরা অতিষ্ঠ হইয়াই শুক্রবার পুলিশের উপর হামলা চালাইয়াছে। যদিও পুলিশ ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে তাহাদের অভিযানের যৌক্তিকতা তুলিয়া ধরিতে যাইয়া এই বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার দোহাই পাড়িয়া থাকে। রিকশাচালকদের বক্তব্য হইল- উচ্চ আদালত শুধু মহাসড়কে এই প্রকার যানবাহন চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়াছে, নগর-মহানগরে তাহা চালাইতে বারণ করে নাই। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হইল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক সমকালকে যেমনটা বলিয়াছেন, তাহাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এইসব যানবাহনের চলাচল বিষয়ে ইতিমধ্যে একটা নীতিমালার খসড়া তৈয়ার করিয়াছেন, যাহা হয়তো অচিরেই চূড়ান্ত হইবে। এই খবরটা পুলিশের অজ্ঞাত থাকিবার কথা নহে। তৎসত্ত্বেও এই অন্তর্বর্তী সময়ে ধৈর্য না ধরিয়া পুলিশের ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে এমন খড়গহস্ত হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক বলিলে বেশি বলা হইবে না।
আমরা অস্বীকার করিতেছি না যে, সমগ্র দেশ বর্তমানে বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং মোকাবিলা করিতেছে; বিদ্যুৎ ব্যবহারে সকলকে যেমন সাশ্রয়ী হইতে হইবে, তেমনি সরকারকেও বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য অগ্রাধিকার খাত চিহ্নিত করিতে হইবে। কিন্তু অগ্রাধিকার খাত চিহ্নিত করিতে যাইয়া এই গরিব রিকশাচালকদের পেটে লাথি মারিতে হইবে কেন? সারাদেশে অন্তত ৪০-৪৫ লক্ষ মানুষ ব্যাটারিচালিত রিকশা চালাইয়া জীবিকা নির্বাহ করেন; তাঁহাদের পরিবার-পরিজনের কথা চিন্তা করিলে মানিতে হইবে, অন্তত দুই কোটি মানুষের জীবন এই বাহনটির উপর নির্ভরশীল। এই কথাও মনে রাখিতে হইবে, আমদানীকৃত ইজিবাইকের বাইরে যত ব্যাটারিচালিত রিকশা রহিয়াছে- যেইগুলির সংখ্যা ঐ ইজিবাইকের চাইতে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি হইবে- ইহাদের সকলই স্থানীয়ভাবে প্রস্তুতকৃত; ইহাকে স্থানীয় মেকানিক বা যন্ত্রবিদদের এক ধরনের আবিস্কার বলিলেও ভুল হইবে না। মোট কথা, ব্যাটারিচালিত রিকশা নির্মাণ ও মেরামতের কারখানাসমূহকে খুব সহজেই এসএমই বা ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্পের দলভুক্ত করা যায়, যাহারা শুধু দারিদ্র্য বিমোচন নয় মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতেও নীরবে হইলেও অবদান রাখিয়া চলিয়াছে। এই প্রসঙ্গে এই কথাটাও বলা দরকার যে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বড় শহরে যাহারা এই ধরনের যানবাহন চালাইয়া জীবিকা নির্বাহ করেন তাঁহাদের অধিকাংশই গ্রামে বসবাসরত পরিবারের জন্য প্রতি মাসে টাকা পাঠাইয়া থাকেন এবং এই টাকা গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখিবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখিয়া চলিয়াছে। আমাদের ধারণা, সরকার এই সমস্ত বিবেচনায় লইয়াই 'থ্রিহুইলার ও সমজাতীয় মোটরযান নীতিমালা' প্রণয়নে হাত দিয়াছে।
এই পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নামে এইসব যানবাহনের চালকদের উপর জুলুম চালাইতে থাকে তাহা হইলে একদিকে যেমন ঐ নীতিমালা প্রণয়নে সরকারের আন্তরিকতা লইয়া প্রশ্ন উঠিবে, আরেকদিকে তেমনি মিরপুরের মতো সংঘর্ষের ঘটনা সমগ্র দেশেই ছড়াইয়া পড়িবে; যাহা কাহারও জন্যই শুভ হইতে পারে না। শুধু তাহাই নহে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার কারণে লক্ষ লক্ষ রিকশাচালক যদি বেকার হইয়া পড়ে তাহা এক ধরনের সামাজিক ও এমনকি রাজনৈতিক অস্থিরতারও জন্ম হইতে পারে, যাহা বর্তমানে দেশজ ও আন্তর্জাতিক নানা কারণে সংকটে নিপতিত আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্যও ভয়াবহ পরিণতি ডাকিয়া আনিতে পারে। তাই আমাদের প্রত্যাশা হইল, সরকার সকল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করিয়া সম্ভাব্য স্বল্প সময়ে ব্যাটারিচালিত রিকশাবিষয়ক নীতিমালা চূড়ান্ত করিবে এবং অন্তর্বর্তী সময়ে এই চালকদের বিরুদ্ধে সকল ধরনের অভিযান বন্ধ রাখিবে।
মন্তব্য করুন