সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমাদের খাওয়া শুরু। তারপর একের পর এক খাচ্ছি। বাঁচার জন্যই খাচ্ছি। তাই তো মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য অন্যতম। আজ বিশ্ব খাদ্য দিবস। খাদ্য দিবসে একটু ভেবে দেখি- আমরা যা খাচ্ছি, তার গুণগত মান ঠিক আছে তো? সংবাদ শিরোনামে প্রায়ই আসে ভেজাল মিশ্রিত খাবারের খবর। তাহলে সঠিক খাবার আমরা খাচ্ছি কি? যেখানে প্রকৃতিপ্রদত্ত খাদ্য নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞ থাকার কথা, সেখানে বিষাক্ত খাদ্যের দুষ্টচক্র স্বাস্থ্যহানির মূল কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নীরব ঘাতকের অমানবিক আচরণে অনেকে অকালে মারা যাচ্ছেন।

রেস্টুরেন্ট আর হাসপাতাল অনেকটা সমানুপাতিক হারে বাড়ছে। মানুষ খাচ্ছে আর হাসপাতালে যাচ্ছে; ফার্মেসিতে ওষুধ কিনছে। প্রতিনিয়ত মনে হয় যেন আমরা জেনে-শুনে বিষ খাচ্ছি। কি ফলমূল কি মাছ-মাংস কিংবা শিশুখাদ্য সবকিছুতেই ভেজাল। এ থেকে পরিত্রাণের পথ আসলে কী হতে পারে- এই ভাবনা আজ আর যথেষ্ট নয়। কারণ জীবনধারণের জন্য খাদ্যের বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য। 

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য পাওয়া একটি কঠিন বিষয়ে রূপ নিয়েছে। ভেজাল খাদ্যের দৌরাত্ম্যে কোনটি ভেজাল আর কোনটি ভেজালমুক্ত, তার পার্থক্য করাটাই এখন দুস্কর। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ীরা অপবিজ্ঞানকে খুঁজে বের করেছেন। তাঁরা নকল খাদ্য উপাদানও বের করেছেন। এটি প্রতারণা তো বটেই, তার চেয়ে বেশি এর স্বাস্থ্যগত ক্ষতি। বিশেষ করে শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারী, কিশোর-কিশোরীরা নকল-ভেজালের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সবচেয়ে বড় শিকার।

ফসল তোলা থেকে শুরু করে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতের ফ্যাক্টরিতেও মেশানো হচ্ছে ভেজাল। সরকারের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের ফাঁকি দিয়ে যে খাদ্যে যে ধরনের ভেজাল মেশালে সহজে চোখে ধরা পড়ার কোনো সুযোগ নেই, সেদিকেই নজর অসাধু ব্যবসায়ীদের। শুঁটকি আড়তে প্রকাশ্যেই কীটনাশক মেশানো হচ্ছে। ফল ও তরিতরকারি দ্রুত বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম গ্রোথ হরমোন, কীট-পতঙ্গ প্রতিরোধে নিষিদ্ধ বিষাক্ত কীটনাশক এবং তাজা ও সতেজ রাখতে ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে। ফল কৃত্রিম উপায়ে পাকাতে ব্যাপকভাবে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, কপার সালফেট, কার্বনের ধোঁয়া, পটাশের লিকুইড সলিউশন প্রয়োগ করা হচ্ছে। মাছে ফরমালিন, মুড়িতে ইউরিয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদিত বোতল ও প্যাকেটজাত খাদ্য, যেমন- শরবত, ফলের রস, জ্যাম-জেলিতে নানা ধরনের ক্ষতিকর রং ও কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। মিষ্টিতে কৃত্রিম মিষ্টিদায়ক ও কাপড়ের রং প্রয়োগ হচ্ছে।

খাবারে বিষক্রিয়ার বিষয়টি দেশি ও আন্তর্জাতিক সব গবেষণায় বারবার উঠে আসছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত হোটেল-রেস্টুরেন্ট বা নামিদামি ব্র্যান্ডের পণ্য, এমনকি বাসাবাড়ির খাদ্যও এখন ভেজালমুক্ত নয়। খাদ্যে ভেজাল ও বিষক্রিয়ার ব্যাপ্তি যে হারে বাড়ছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। সন্দেহ নেই, কৃষি বিজ্ঞানীদের নানা ধরনের গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন বীজ ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করায় খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে এবং বিশ্ব জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান ধারার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাদ্য উৎপাদনও বাড়ছে। তবে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু উৎপাদন পর্যায়ে উত্তম চর্চা অনুসরণের মাধ্যমে তা সম্ভব নয়; কেননা বাজারজাত প্রক্রিয়া ও বিক্রির সময়ও পণ্য নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে কৃষির উৎপাদনে সঠিক জ্ঞান, দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি সঠিক কৃষি উপকরণের জোগান দিতে হবে। কাজ করতে হবে বাজারজাতকরণ ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নতিতে। কৃষকদের কাছে তথ্য নিয়ে যেতে হবে। সব মিলিয়ে কাজ করতে হবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং কৃষিবান্ধব নীতি ও পরিকল্পনা নিয়ে।