ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

জীবনযাত্রার ব্যয় এবং ভোক্তার নাভিশ্বাস

মতামত

জীবনযাত্রার ব্যয় এবং ভোক্তার নাভিশ্বাস

সুলতান মাহমুদ

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২২ | ০৬:৩৮ | আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২২ | ০৮:০৮

বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এখন একটি নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষকে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের সঞ্চয় হারাচ্ছে। নিম্নবিত্ত ঋণ করে সংসার চালাচ্ছে। সীমিত আয়ের মানুষের ভোগব্যয় কমাতে হচ্ছে। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কথা বলে আলু এবং ডিমের দাম বেড়েছে, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

সুদের হার একক অঙ্কে নির্ধারণ করা, বাজার ব্যবস্থাপনায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য এবং জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। আর এ কারণে প্রতিটি পরিবারের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১০%-১৫% হারে। কিন্তু তাদের আয় তো আর সেভাবে বাড়েনি বরং কারও কারও আয় কমে গেছে।

মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পর্যায়ের মানুষকে তাদের মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, ইত্যাদি মেটাতে বিশেষ করে খাদ্য চাহিদা পূরণে হিমশিম থেকে হচ্ছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৩৬.৫০ টাকা, নাজিরশাইল চাল ৬০ টাকা, আটা (খোলা) ২৩.৪৫ টাকা, ময়দা (খোলা) ৩৩.৫০ টাকা, সয়াবিন তেল (খোলা) ১০৫ টাকা, চিনি ৬৬.৫০ টাকা, মসুর ডাল (মোটা) ৬৭.৫০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১১৫ টাকা, গরুর মাংস ৫৫০ টাকা, মুরগির ডিমের ডজন ছিল ৯৫ টাকা।

গত মাসে খুচরা বাজারে মোটা চালের দাম ৫৫ টাকা, নাজিরশইল চাল ৮০ টাকা (সর্বনিম্ন), আটা (খোলা) ৫২ টাকা, ময়দা (খোলা) ৬২ টাকা (সর্বনিম্ন), সয়াবিন তেল (খোলা) ১৯২ টাকা, চিনি ৮৪ টাকা, মসুর ডাল (মোটা) ১৩৫ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১৭৫ টাকা, গরুর মাংস ৭৫০ টাকা, মুরগির ডিমের ডজন ১৫০-১৫৫ টাকা। দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির হারে আয় বা মজুরি না বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। ফলে তাদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায় উল্লেখযোগ্য হারে। 

স্থানীয় বাজারে যখনই কোনো পণ্যের দাম বাড়ে, তখনই ব্যবসায়ী ও পাইকাররা আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত দিয়ে থাকেন। ২৭ সেপ্টেম্বর সালে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে আগস্ট ২০২১ সাল থেকে আগস্ট ২০২২ পর্যন্ত গমের দাম বিশ্ববাজারে বেড়েছে ৮% যা অভ্যন্তরীণ বাজারে বেড়েছে প্রায় ৬৭%। একইভাবে, চালের দাম বিশ্ববাজারে বেড়েছে ৭.২১% যা অভ্যন্তরীণ বাজারে বেড়েছে প্রায় ১৯%। গত কয়েক মাস ধরে বাজারে ১ টাকা, ২ টাকা, ৫ টাকার নোট সংকট দেখা যাচ্ছে। ফলে বাজারের বেশিরভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সমন্বয় করে দোকানদার সুবিধা নিচ্ছে আবার উৎপাদনকারীও সেভাবে সমন্বয় করে দাম নির্ধারণ করছে। ফলে ক্রেতাকে সর্বনিম্ন অন্তত ৩-৪ টাকা বেশি দাম গুনতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাব অনুসারে, বার্ষিক জনপ্রতি চালের ব্যবহার ১৫২ কেজি। অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ যোগ করে অপচয়, নষ্ট ও পশুখাদ্যসহ বাংলাদেশে মোট বার্ষিক চালের চাহিদা ৩ কোটি ১০ লাখ ২৫ হাজার টন। বার্ষিক জনপ্রতি ১৮২.৫০ কেজি হারে দেশটির মোট বার্ষিক চাহিদা ৩ কোটি ৫৬ লাখ টন। কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দেশটিতে মোট চাল উৎপাদিত হয়েছে তিন কোটি ৮৭ লাখ টন। এ ক্ষেত্রে, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হয়েছে ৩১ লাখ টন। 

বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি বা ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চালের দামের নিয়ন্ত্রক এখন ৫০টি চালকল। আটা ময়দার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে গুটিকয়েক বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত এক দশকে দেশে ডিমের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ। দেশে প্রতিদিন ডিমের চাহিদা সাড়ে ৪ কোটি। সেখানে পোলট্রি খাত এককভাবেই উৎপাদন ও সরবরাহ করতে পারে ৩ কোটি ৮০ লাখ ডিম।

দেশে ডিমের চাহিদার থেকে উৎপাদন বেশি হওয়া সত্ত্বেও ডিমের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের (সিন্ডিকেট, আড়তদার, বাজার মালিক/ব্যবসায়ী সমিতি, চাঁদা সংগ্রহকারী ইত্যাদি) দৌরাত্ম্যের কারণে। বাংলাদেশে ডিমের দাম নির্ধারণ করা হয় ঢাকা, রাজশাহী এবং কিশোরগঞ্জ থেকে। আড়তদাররা খামারিদের কাছ থেকে কত টাকায় কিনতে পারে তার একটা হিসাব করে এবং ঢাকার বাজার চাহিদার ওপর নির্ভর করে ডিমের দাম নির্ধারণ করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে ডিম উৎপাদনকারী বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ডিমের দাম কৃত্রিমভাবে বৃদ্ধি করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন তেল, চিনি, মসুর ডাল এবং ব্রয়লার মুরগির দাম বৃদ্ধিতে একইভাবে বড় বড় প্রতিষ্ঠান কমিশন বাণিজ্য এবং নিলাম প্রক্রিয়ায় নিজেদের এজেন্টদের নিয়োগ করে অস্বাভাবিক হারে মুনাফা লুটে নিচ্ছে।

বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনা এখন অলিগার্কিদের দখলে। একটি ওলিগোপলি বাজার কাঠামোতে যেমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা বিদ্যমান থাকে যারা একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বা সহায়তা করে। ওই প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা তাদের প্রভাব খাটিয়ে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে থাকে এবং সর্বাধিক মুনাফা লুটে নেয়। সুতরাং, এখানে ভোক্তারা শুধু মূল্য গ্রহণকারী বা মেনে নেওয়াকারী হয়ে থাকে। একটি নিখুঁত প্রতিযোগিতার বাজারে যেখানে উৎপাদক উদ্বৃত্ত এবং ভোক্তার উদ্বৃত্ত সর্বাধিক হয় যা অর্থনীতির জন্য সর্বাধিক কল্যাণকর। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো বাদে বাংলাদেশের মফস্বল এলাকার বাজারগুলোও এখন বাজার মালিক সমিতির নিয়ন্ত্রণে। বাজারগুলো যেহেতু নিয়ন্ত্রিত, সে ক্ষেত্রে ভোক্তার উদ্বৃত্ত প্রায় অসম্ভব কারণ বিক্রেতার উদ্দেশ্যেই হলো সর্বাধিক মুনাফা অর্জন। খালি চোখে নিত্যপণ্যের বাজার নিখুঁত প্রতিযোগিতামূলক মনে হলেও মধ্যস্বত্বভোগীদের (সিন্ডিকেট, আমদানিকারক, আড়তদার, বাজার মালিক/ব্যবসায়ী সমিতি, চাঁদা সংগ্রকারী ইত্যাদি) দৌরাত্ম্যের কারণে সেগুলো ওলিগোপলি বাজারে পরিণত হয়েছে। 

মুদ্রাম্ফীতি এবং মূল্যম্ফীতির মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশ সরকার মূল্যম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি গ্রহণ করে সুদের হার বাড়াতে পারে, বিশেষ করে জনগণের আমানতের ওপরে। অর্থনীতিতে মাত্রাতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহ হ্রাসে কঠোর নীতি অনুসরণ করতে পারে। ডিজেলের দাম কমানো যেতে পারে। অবচয় রোধ করে সরকার ব্যয় সংকোচিত করতে পারে। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে আরও শক্তিশালী করে তাদের দায়িত্ব পালনে সক্রিয় এবং পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া দরকার। বাজার ব্যবস্থাপনার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তি খাতের ওপর না রেখে সরকারের অংশগ্রহণে অন্তর্ভুক্তমূলক বাজার ব্যবস্থাপনা কাঠামো তৈরি করা যেতে পারে। যেসব পণ্যে বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর, সেগুলোর ওপর গবেষণা করে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি ও বীজের সরবরাহ নিশ্চিত করে কৃষকদের অনুপ্রাণিত করতে পারে। ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি ইউনিয়নে সরকার পরিচালিত কমপক্ষে একটি করে ডিলার নিয়োগ করা যেতে পারে। 

সরকারের পাশাপাশি জনগণেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। যখন কোনো দ্রব্যের দাম মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাবে, জনগণের উচিত ওই দ্রব্যের ভোগ ব্যয় কমানো এবং গ্রাম পর্যায়ে জনগণের সঞ্চিত অর্থ কৃষি কাজে বিনিয়োগ করে বাজারনির্ভরতা কমাতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশের প্রতি ইঞ্চি আবাদি জমি চাষ করতে হবে। সুষ্ঠু ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে আমাদের কঠোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বিশ্ববাজারে ভূমিকা পালনে আর কী কী করা যেতে পারে সে বিষয়েও গবেষণা পরিচালনা করতে হবে। 

আরও পড়ুন

×