ব্রিটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময় বোধ হয় এ বছরের গ্রীষ্ফ্মকাল। এ সপ্তাহে সেখানে যা ঘটেছে, সেটাও খারাপ নজির হয়ে থাকবে। ব্রিটেনের সবচেয়ে কম সময়ের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লিজ ট্রাস বৃহস্পতিবার পদত্যাগ করেছেন। ছয় বছরের মধ্যে ব্রিটেন চারজন প্রধানমন্ত্রী দেখেছে। কিন্তু কেউই এর মধ্যে জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন। এখন আবার নির্বাচন ছাড়াই পঞ্চম ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন। ব্রিটেনের রাজনীতি ক্লাবীয় গণতন্ত্র হিসেবে বিখ্যাত; জনগণের গণতন্ত্র নয়। প্রতি পাঁচ বছর পর জনগণ একটি ক্লাবকে নির্বাচিত করে। এর পর ক্লাবটি অবারিত স্বাধীনতা ভোগ করে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়- জাতিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কে নেতৃত্ব দেবে। এমনকি যতক্ষণ ক্লাবের প্রতি আনুগত্য বজায় থাকে, ততক্ষণ তিনি দায়িত্বে থাকেন। বৃহস্পতিবার যিনি লিজ ট্রাসের প্রধানমন্ত্রিত্বে ছুরি চালান, তিনি হলেন গ্রাহাম ব্র্যাডি, যিনি যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ আনুগত্যের প্রধান পরীক্ষা নিয়ে থাকেন। প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন লিজ ট্রাস।

ট্রাস মাত্র ছয় সপ্তাহ প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন। এটা অবশ্য বলা যায়, অন্তত ব্রিটেন জানে কীভাবে এর নেতৃত্বকে দ্রুত সংশোধন করতে হয়। অন্য জাতি হয়তো বিষয়টি থেকে শিক্ষা নিতে পারে। কনজারভেটিভ পার্টির মেধা অনেক আগেই বরিস জনসনের ব্রেক্সিট ক্রনিজম নিয়ে শেষ হয়ে যায়। চারজন নেতা এবং চারজন মন্ত্রী এলেন এবং গেলেন। ব্রিটেনে একজন প্রধানমন্ত্রী সাধারণত কোনো কিছুর পক্ষে অবস্থান নেবেন- এমনটাই ধারণা করা হয়। তবে বৃহস্পতিবার লিজ ট্রাস ডাউনিং স্ট্রিটে দাঁড়ান একেবারে শূন্য হাতে।

গণতন্ত্রের জন্য অনিবার্য বিষয় হলো, ভোটে ফেরা। কনজারভেটিভ দলের উচিত হবে, নতুন কারও নেতৃত্বে দলের একটি ইশতেহার প্রথমে প্রস্তুত করা এবং তার ওপর জনমত আহ্বান করা। সেখানে এই মুহূর্তে লেবার পার্টি নির্বাচনের বিষয়টি তুলতে পারে। তাদের সে দাবি ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেতে পারে। অনভিজ্ঞতা সত্ত্বেও কেইর স্টারমারের নেতৃত্বে লেবার পার্টি হয়তো জিতেও যাবে। জাতীয় জরুরি পরিস্থিতির কারণে তিনি এ সুবিধা পচ্ছেন। তাতে গণতন্ত্র পুনরায় সতেজ হবে।

তবে এই মুহূর্তে তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। পুরোনো সেই রক্ষণশীল ক্লাবই এখন ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতি তথা ব্রিটেনের পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা দখল করে আছে। এবং নতুন কিছু আনার ব্যাপারে দলটির অধিকাংশ সদস্যই রাজি নন। তাঁদের এখনও দুই বছরের বৈধ মেয়াদ রয়েছে। কিন্তু তাঁদের কাজ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তবে সর্বাগ্রে জাতীয় স্বার্থকেই বিবেচনায় নিতে হবে। জেরেমি হান্ট এখন ব্রিটেনের চ্যান্সেলর। যিনি তাঁর পদক্ষেপের কারণে এখন প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন, বিশেষ করে ব্রিটেনের উদ্ধার কর্মসূচি উপস্থাপনার মাধ্যমে তিনি আলোচনায় রয়েছেন। যদিও তাঁর কর্মসূচি কঠিন এবং অজনপ্রিয়। কিন্তু তার বাস্তবায়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ নির্বাচনের কর্মসূচির মধ্যে একে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। সে জন্য লেবার পার্টিকেও ধৈর্য ধরতে হবে। মাঝেমধ্যে রাজনীতির ওপর অবস্থার আলোকে অর্থনীতির প্রাধান্য পাওয়া উচিত।

এখন লিজ ট্রাসের ব্যাপারে কী বলা যায়? তিনি ছয় সপ্তাহ আগে তাঁর দল থেকে নির্বাচিত হয়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু এমপিদের পক্ষ থেকে তিনি এক ধরনের 'হতবিহ্বল' অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন। তাঁরা বাজেটে যেভাবে জনসনের পরিকল্পনা বাদ দেন, সেটা আদর্শগতভাবে অযৌক্তিক। লিজ ট্রাস তাঁর চ্যান্সেলর কোয়াসি কোয়ার্তেংকে বরখাস্ত করেন। তাঁকে জেরেমি হান্টের বাজেট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। তাতেই তাঁর অপমান স্পষ্ট। বস্তুত জনস্বার্থে তাঁর কার্যপ্রণালি ছিল খোঁড়া এবং ভাসা ভাসা। কনজারভেটিভরা এখন স্পষ্ট করছেন- তাঁদের নেতৃত্ব নির্বাচন ভুল ছিল। আগামী নির্বাচনে কি তাঁরা ক্ষমা প্রার্থনা করবেন?

এখন সবচেয়ে যৌক্তিক সমাধান মনে হচ্ছে জেরেমি হান্টকে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে বসানো এবং ঋষি সুনাককে তাঁর অর্থ বিভাগের দায়িত্বে ফিরিয়ে আনা এবং পেনি মর্ডান্টকে পররাষ্ট্র বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া। একই লক্ষ্যে তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অর্থনীতির চাকাকে শক্তিশালী করবে। তবে একটি উন্মুক্ত প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে- এমপিরা কি তাঁদের সবাইকে এই পদগুলোতে মেনে নেবেন? বলা বাহুল্য, জেরেমি হান্ট ছয় মাস আগে তাঁদের অষ্টম পছন্দের মানুষ ছিলেন। যদিও এটা তাঁর কৃতিত্ব যে, তিনি কোয়ার্তেংয়ের বাজেট পরিকল্পনা সংশোধন করেছেন এবং দুই সপ্তাহ মন্দাবস্থায় থাকা বাজারে স্থিতিশীলতা এনেছেন। তাঁর এ কাজের পুরস্কার হিসেবে প্রধানমন্ত্রিত্বই তাঁর প্রাপ্য। কিন্তু এটি খুব স্বস্তিদায়ক হবে বলে মনে হয় না। এমনকি খুব বেশিদিন তিনি থাকতেও পারবেন না।

তবে কনজারভেটিভদের এটিই শেষ সুযোগ হওয়া উচিত। সংসদীয় সার্বভৌমত্বের অধিকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্যাখ্যা করা এবং ভোটারদের ইচ্ছার প্রতিফলনে ব্যবস্থা নেওয়া হাউস অব কমন্সের অধিকার। ২০১৯ সালের নির্বাচনে জনগণ যে প্রত্যাশায় ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিল; কনজারভেটিভ দলীয় এমপিরা তার অপব্যবহার করেছেন। নেতৃত্ব ও আরও নানাবিধ দিক থেকে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁদের আর একটা সুযোগ রয়েছে। যদি তাঁরা আবার ব্যর্থ হন, তবে জনগণ রাস্তায় নেমে আসবে।

সাইমন জেনকিন্স: ব্রিটিশ লেখক ও সাংবাদিক; গার্ডিয়ান থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক