ইলিশের উৎপাদন বাড়াইবার লক্ষ্যে মৎস্য বিভাগ প্রতি বৎসরের ন্যায় এইবারও জাতীয় মৎস্যটির প্রজনন মৌসুম উপলক্ষে গত ৭ অক্টোবর হইতে ২২ দিনের জন্য ইলিশ আহরণ, বিক্রয় ও সংরক্ষণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছে। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, এই সময়ে বেকার হইয়া পড়া জেলেদের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি মিটাইবার জন্য সরকারের নিকট হইতে ২৫ কেজি করিয়া চাউল পাওয়ার কথা। কিন্তু দুঃখজনক হইলেও সত্য, শুক্রবার সমকালের এক প্রতিবেদনে যেমনটা বলা হইয়াছে, বিশেষ করিয়া রাজবাড়ীর বিভিন্ন উপজেলা এবং রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার অধিকাংশ জেলে নিষেধাজ্ঞা শুরুর দুই সপ্তাহ পরও সেই চাউল পাননি। এই অবস্থায় সংশ্নিষ্ট জেলেরা পরিবার-পরিজনসহ নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করিতেছেন। শুধু তাহাই নহে, উপায়ান্তর না দেখিয়া বঞ্চিত জেলেদের কেহ কেহ নিষেধাজ্ঞা ভাঙিয়া জাল লইয়া নদীতে নামিবার প্রয়াস চালাইতেছেন। অন্যদিকে, স্থানীয় প্রশাসনের এই চাউল বরাদ্দ করিবার কথা এবং জনপ্রতিনিধিগণ- তালিকাভুক্ত জেলেদের মধ্যে বণ্টন করিবার কথা; একে অপরের স্কন্ধে দায় চাপাইয়া সমস্যাটি পাশ কাটাইতে চাহিতেছেন।

যদি বলা হয়, স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের সাধারণভাবে দরিদ্র মানুষের প্রতি এবং বিশেষভাবে জেলেদের প্রতি বিরূপ মনোভাবের কারণেই সমস্যাটির উদ্ভব ঘটিয়াছে, তাহা হইলে খুব একটা ভুল বলা হইবে বলিয়া মনে হয় না। কারণ তাঁহাদের এহেন অমানবিক মনোভাবের আরেকটি নমুনা হইল, রাজবাড়ীতে সরকারি কার্ডধারী জেলের সংখ্যা ১৩ সহস্রাধিক হইলেও খাদ্য সাহায্যের তালিকায় রাখা হইয়াছে মাত্র সাড়ে চার সহস্রকে। চারঘাটে কার্ডধারী জেলে আছেন ১১ শতাধিক। কিন্তু খাদ্য সাহায্য পাইবেন মাত্র ৫৭০ জন। এই বিপুলসংখ্যক জেলেকে খাদ্য সাহায্যের বাহিরে রাখিবার কারণ হিসাবেও অদ্ভুত এক যুক্তি প্রদর্শন করা হইয়াছে। তাহা এতদ্রূপ- শুধু ইলিশ আহরণে যুক্ত জেলেদের জন্যই সরকারি চাউল বরাদ্দ হইয়াছে! কিন্তু নিষেধাজ্ঞা কি শুধু ইলিশ আহরণের উপর দেওয়া হইয়াছে? নদনদীতে তো সব ধরনের জেলেকেই নামিতে বাধা দেওয়া হইতেছে। সরকারি সাহায্যবঞ্চিত এই জেলেরা পরিবার-পরিজন লইয়া বাঁচিবেন কী প্রকারে?

প্রতিবেদনে শুধু রাজবাড়ী ও রাজশাহীর কতিপয় এলাকার জেলেদের দুর্দশার কথা বলা হইলেও তাহা হইতে চলমান নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন অপর এলাকাসমূহের জেলেদের অবস্থাও উপলব্ধি করা যায়। কারণ ঐ এলাকাসমূহের সব জেলেকে বেকার বসিয়া থাকিয়া ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করিতে হইলেও শুধু কথিত ইলিশ শিকারি জেলেদের চাউল দিবার সিদ্ধান্ত রাজবাড়ী বা চারঘাটের প্রশাসনের নহে; এই সংক্রান্ত সরকারি নীতিই মাঠ পর্যায়ে অনুসরণ করা হইতেছে। অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক জেলেকে বাদ দিয়া শুধু ইলিশ শিকারিদের সাহায্য করিবার সরকারি নীতি নিশ্চয় অন্য এলাকাসমূহেও কার্যকর করা হইয়াছে। আবার সংশ্নিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যথাযথ তদারকির যে ঘাটতির কারণে রাজবাড়ী ও রাজশাহীতে সাহায্যপ্রাপ্তির তালিকায় থাকিবার পরও জেলেদের সেই সাহায্য হইতে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা বঞ্চিত করিতেছেন; অন্য এলাকাসমূহে তাহার অন্যথা হইবার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নাই। ইহার আগে একাধিক সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমরা বলিয়াছি, সামাজিক সুরক্ষা খাতে সাম্প্রতিক বৎসরগুলিতে বরাদ্দ বাড়াইলেও বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক নীতিসমূহ সর্বতোভাবে দরিদ্রবান্ধব নহে। অন্তত সম্পদের সুষম বণ্টন প্রশ্নে সরকারের মধ্যে দরিদ্র মানুষের প্রতি স্পষ্ট উদাসীনতা দৃশ্যমান। জেলেদের আলোচ্য বঞ্চনাও সরকারের এই নীতিরই প্রতিফলন বলিয়া আমরা মনে করি। তবে সরকারের এই বৈষম্যমূলক নীতি যে সমাজের জন্য শুভ ফল দিতে পারে না, তাহাও আমরা অনেকবার বলিয়াছি। ইহাও মনে রাখিতে হইবে, ঠিক একই কারণে ইলিশের উৎপাদন বাড়াইবার জন্য সরকার যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করিতেছে, সেইগুলিও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতার পর্যবসিত হইতে পারে। কারণ ক্ষুধার জ্বালা বড় জ্বালা, যাহা ভুক্তভোগীকে যে কোনো অপকর্মের দিকে ঠেলিয়া দিতে পারে।

মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে যেই সাফল্য অর্জন করিয়াছে, তাহার পশ্চাতে ঐ প্রান্তিক মানুষদের অবদান অন্য কাহারও চাইতে কিঞ্চিৎ নহে। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার জেলেদের অবদানের কথা স্মরণে রাখিয়া শুধু সকল জেলেকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনা নহে; তাহাদের জীবনমানের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করিবে।