বরিশাল সদর উপজেলার চর কাউয়ায় ইয়াসিন খাঁ নামে এক পোশাদার চোরকে গ্রেপ্তার করেছে বন্দর থানার (সাহেবেরহাট) পুলিশ। টহলরত অবস্থায় কিংবা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এ চোরকে গ্রেপ্তার করা হয়নি; বরং চোরের ফোনেই ঘটনাস্থলে গিয়ে আটক করা হয়। যদিও চোর তাকে বিপদ থেকে উদ্ধারের অনুরোধ জানিয়ে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করে। উদ্ধারে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে- গত মঙ্গলবার রাতে একটি মুদি দোকানে তালা ভেঙে চুরির উদ্দেশ্যে প্রবেশ করে ৪০ বছরের যুবক ইয়াসিন খাঁ। মালপত্র গোছাতে গোছাতে কখন সকাল হয়ে গেছে, টের পায়নি। মালপত্র নিয়ে বের হতে গিয়ে দেখে, ভোরের আলো ফুটে গেছে; চারপাশে অনেকের আনাগোনা। এ সময় বের হতে গেলে গণপিটুনিতে পড়ার আশঙ্কা আছে- এমনটা ভেবে সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন থেকে ৯৯৯-এ কল করে। পরে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে। চাকরিজীবনে এমন ঘটনা এটাই প্রথম বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্নিষ্ট থানার ওসি।

ইয়াসিনের ঘটনাটি সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচিত হচ্ছে। এরই মধ্যে অন্য একটি চুরির মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে তাকে। ঝালকাঠির নলছিটির সন্তান ইয়াসিন বর্তমানে পরিবার নিয়ে বরিশাল নগরের কালু শাহ সড়ক এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে থাকে। পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে সে পেশাদার চোর। ইয়াসিন খাঁর চুরি ও আটকের ঘটনাটি নিঃসন্দেহে বিরল। তাকে উদ্ধার ও পরে গ্রেপ্তারের বিষয়টি একটি অপরাধ সংবাদ হলেও এর মধ্যে বিনোদনের উপাদান রয়েছে।
সাধারণত চোর চুরি করে নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ইয়াসিন এত মালপত্র গুছিয়েছে, কখন ভোর হয়ে গেছে তা টেরই পায়নি। এ ক্ষেত্রে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিলেও জনতার গণধোলাই এড়াতে সে ৯৯৯-এ ফোন করেছে। গণধোলাইয়ের চেয়ে পুলিশের হাতে আটক হওয়াকে নিরাপদ মনে করেছে এ চোর।
গ্রামগঞ্জে আগে প্রায়ই চুরির ঘটনা শোনা যেত। সিঁধ কেটে কিংবা জানালা ভেঙে ঘরে ঢুকে মূল্যবান সরঞ্জাম চুরি করে নিয়ে যেত। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো চোর ধরাও পড়ত। তখন গ্রামের মাতবররা চোরের মাথা ন্যাড়া করে আলকাতরা মাখাতেন, এরপর জুতার মালা গলায় পরিয়ে অলিগলিতে ঘোরাতেন। পরে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো। ছেড়ে দেওয়ার মূল কারণ ছিল মামলার বাদী পাওয়া যেত না। কারণ সাধারণ মানুষ থানা, পুলিশ, আদালতকে এড়িয়ে চলতে চায়। তারা মনে করে, মামলার বাদী কিংবা সাক্ষী হলে মাসে মাসে নিজের পয়সায় জেলা সদরে গিয়ে আদালতে হাজিরা দিতে হবে।
ইয়াসিন সম্ভবত এ পরিস্থিতিরই সুযোগ নিতে চেয়েছে। ৯৯৯-এ ফোন না দিয়ে বের হলে বা তাকে স্থানীয়রা ওই অবস্থায় ধরতে পারলে গণধোলাই দিত। এতে জখম হওয়ার পাশাপাশি মৃত্যুঝুঁকিও ছিল। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া আমরা সমর্থন করি না; বরং তাকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়াই হতো সঠিক কাজ। কিন্তু উত্তপ্ত জনতার সেই ধৈর্যশক্তির দৃষ্টান্ত কমই দেখা যায়। জনতার মারের চেয়ে পুলিশকে বেশি নিরাপদ মনে হয়েছে ইয়াসিনের। এর কারণ হয়তো এর আগেও চুরি করে কারাগারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে রয়েছে। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে, মুদি দোকানি প্রথমে মামলা করতে রাজি হননি। ফলে ইয়াসিনকে অন্য চুরির মামলায় চালান দিতে হয়েছে। মামলা তো এখানেই দুর্বল হয়ে গেল। আর পুলিশকে যদি একটু উদাসীন রাখা যায় তাহলে খালাস পেতেও সময় লাগবে না ইয়াসিনের।
ইয়াসিন পেশাদার চোর হওয়া সত্ত্বেও তাকে চূড়ান্ত শাস্তির আওতায় না আনতে পারার দায় কার? আমার মতে, এ দায় প্রথমত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একজন পেশাদার চোরকে অপরাধ থেকে নিবৃত্ত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি তারা জনতার মধ্যেও তাদের পেশাদারিত্বের বিষয়ে আস্থা জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। রাষ্ট্রের দায়টা হলো, সংশ্নিষ্ট আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার না করে তাকে ভোঁতা আইনে পরিণত করা হয়েছে। এর সুযোগ নিচ্ছে ইয়াসিনের মতো পেশাদার চোরেরা। এদের যথাযথ পুনর্বাসনের মাধ্যমে সমাজের মূলধারায় ফিরে আসতে উদ্বুদ্ধ করতেও ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র।
মিজান শাজাহান: সহ-সম্পাদক, সমকাল