'চল মিনি আসাম যাব দ্যাসে বড় দুখ রে'- কবি কালি দাশগুপ্তের এ কবিতা আমাদের কানে এখনও গীত হয়ে বাজে। কবিতার শক্তি হোক আর গানের সুর- এ বাণী যেন এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে ভারতের আসামের বাঙালি মুসলমানের জন্য।

ভালো কাজ ও ভালো মাইনের সঙ্গে নিরাপদ জীবনযাপনের লোভ দেখিয়ে ১৮৮৫ সালের পরে ব্রিটিশ সরকার তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর জেলার দরিদ্র মুসলমান চাষিদের আসামে যেতে উৎসাহিত করে। আবার সংখ্যায় কম হলেও জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারের মুসলমান চাষিরাও তাতে যোগ দেন। চা বাগান তৈরি, রেললাইন সম্প্রসারণ ও কৃষিকাজের জন্যই মূলত ব্র্রিটিশ শাসকরা শ্রমিক শ্রেণির খেটে খাওয়া মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে আসামে নিয়ে যান। এ শ্রেণির লোকের হাত ধরে আসামের অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে উঠলেও তাঁরাই ওখানে অত্যাচারিত, প্রতারিত হয়ে আসছেন, যার সর্বশেষ নজির আসামের মিঞা পরিষদের একটি সংগ্রহশালায় তালা।

সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে- 'মিঞা মিউজিয়াম' নামে আসামে বাংলাভাষী মুসলমানের সাংস্কৃতিক সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র দু'দিন পরেই সিলগালা করে দিয়েছে রাজ্য সরকার। আসাম সরকার বলছে- সরকারি প্রকল্পের বাসস্থানের জন্য দেওয়া একটি বাড়িতে ওই মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়েছিল বলেই সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং তিনজন উদ্যোক্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এমন কী ছিল মিঞা মিউজিয়ামে, যার জন্য এটি বন্ধ করা হয়েছে? সেখানে ছিল লাঙল, মাছ ধরার সরঞ্জাম, গামছা, লুঙ্গি। এসব মূলত বাংলাভাষী মুসলমান কৃষকরা ব্যবহার করেন। আপাত নিরীহ বস্তুগুলো শাসকদের কেন 'বিরক্ত' করল? স্মরণ করা যেতে পারে- একসময় আসাম মানুষ বসবাসের অযোগ্য ছিল। কালাজ্বরে হাজারো কৃষকের মৃত্যু উপেক্ষা করে সেখানকার জঙ্গল কেটে বসবাস উপযোগী সভ্যতা গড়ে বাঙালি মুসলমান। কিন্তু পতিত ভূমি যখন সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা হয়ে ওঠে, তখনই সেখানে চোখ পড়ে অহমিয়াদের। দ্রুতই পরিস্থিতি বিরূপ হতে থাকে বাঙালি মুসলমান বা মিঞাদের জন্য।

পূর্ব বাংলা থেকে আসামে যাওয়া বাংলাভাষী মুসলমানদের তাচ্ছিল্য করে মিঞা বলে ডাকা হতো। যদিও পূর্ববঙ্গে মিঞা বলতে সল্ফ্ভ্রান্ত পরিবারকে বোঝানো হয়। আসামে গিয়ে সেটির অর্থ বদলে যাওয়ার পেছনে রয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিপীড়ন।

যাহোক, মিঞা মিউজিয়াম খোলার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আসামের খোদ মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। তার বক্তব্য- লাঙল কি শুধু মিঞারা ব্যবহার করেন? অসমীয়ারাও তো লাঙল ব্যবহার করেন! মাছ ধরার যে সরঞ্জাম রাখা হয়েছে, তাও তো তপশিলি জাতির মানুষ ব্যবহার করেন! গামছাও তো আসামেরই গামছা। শুধু লুঙ্গিটাই তাঁরা ছাড়া আর কেউ ব্যবহার করেন না। সরকারের কাছে তাঁরা এটি প্রমাণ করুক যে লাঙল শুধু মিঞারাই ব্যবহার করেন, অসমীয়ারা করেন না। আসামের মুখ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্যে ক্ষমতাসীন বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চরিত্রই প্রকাশ পেয়েছে।

প্রশ্নটি বরং উল্টোভাবে করা যেতে পারে। লাঙল, মাছ ধরার সরঞ্জাম, গামছা, লুঙ্গি কি বাঙালি মুসলমানের ব্যবহার্য সামগ্রি নয়? যদি কেউ নিজ সম্প্রদায়ের সামগ্রী সংরক্ষণ করতে চায়, অসুবিধা কোথায়? আসল কথা হচ্ছে, আসামে বাঙালি মুসলামানের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এখন রাজনৈতিক ইস্যু করে তুলছে সেখানকার উগ্র জাতীয়তাবাদীরা।

এর আগে মুসলমানদের 'মিঞা কবিতা' নিয়ে আসামে বিতর্ক হয়েছিল। এক বিশেষ ধরনের উপভাষায় লেখা কবিতাকে 'মিঞা কবিতা' বলা হয়। এ উপভাষার উৎস ময়মনসিংহ, পাবনা, ঢাকা- বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল। এর মধ্যে মিশে যায় অসমীয়াসহ নানা স্থানীয় ভাষাও। এ কাব্যরীতিতে আসামের বাঙালি মুসলামানরা তাঁদের সামাজিক বঞ্চনা ও নির্যাতনের ছবি তুলে ধরেছেন। তাতেই এ কাব্যরীতির বিরুদ্ধে ঘৃণা ও সাম্প্রদায়িক উত্তাপ ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল। রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র অপরাজিতা ভুঁইয়া বিবিসিকে বলেছিলেন- মিঞারা এসব কবিতায় সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলছেন। এরা বাইরের জগতে একটি ভুল ছবি তুলে ধরার জন্যই এসব আজেবাজে লিখে চলেছে।

আমাদের প্রশ্ন- গান-কবিতায় প্রতিবাদ, অধিকারের দাবি উচ্চারিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। সেখানে আসামের বাঙালি মুসলমানরা নিজেদের মনের কথা বলার জন্য এমন একটি দারুণ মাধ্যমকে কেন ব্যবহার করবেন না?

ভারতের বিজেপি শাসিত আসামে এর আগে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) প্রণয়নের নামে বাঙালিদের হয়রানির প্রতিবাদে সেখানে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ হয়েছিল। এটি মূলত 'বঙাল খেদা' আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে বর্তমান ধারায় এসে মিলেছে। যার মূলে রয়েছে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও ভোটের রাজনীতি। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশরা ভারত ভাগ করার মধ্য দিয়ে যে বিভক্তি শুরু করেছিল, তা এখনও রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এ বিভক্তি আরও চরমে পৌঁছেছে। সেই সঙ্গে ধর্মীয় বিভেদ তুলে দিন দিন মানুষকে প্রতারিত ও নির্যাতিত করে চলেছেন এ অঞ্চলের রাজনীতিবিদরা। যে মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে বাঙালি মুসলমানকে আসামে নেওয়া হয়েছিল, সেই রাজনৈতিক নীতির উত্তরাধিকার এখনও বহমান।

আসামের বাঙালি মুসলমানরা যখন গেয়ে ওঠেন- হে যদুরাম, ফাঁকি দিয়া পাঠাইলি আসাম; তখন সংগত কারণেই আমাদের সামনে এ অঞ্চলের রাজনীতিবিদদের মুখই ভেসে ওঠে।

এহ্‌সান মাহমুদ: সহ-সম্পাদক, সমকাল