বাংলাদেশের প্রগতিশীল মহল প্রায়ই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করার কথা বলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সবসময় তৎপর, বিশেষত পূজা-পার্বণে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বলতে তাঁরা মূলত দেশের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে শান্তি ও সৌহার্দ বজায় রাখার কথা বলেন। ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী দেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮ শতাংশ হিন্দু।

আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা কেন বলি? কারণ একটি দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতাসহ সামগ্রিক অগ্রগতি নির্ভর করে সে দেশের বিভিন্ন ধর্ম, গোষ্ঠী, বিশ্বাসী, বর্ণ, জাতির নাগরিকের সহাবস্থানের ওপর। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশকে 'সোনার বাংলা' হিসেবে দেখার যে আকাঙ্ক্ষা ৫১ বছর আগে তৈরি হয়েছিল, সেটি যদি পেতে চাই তাহলে সব মত ও পথের মানুষের সহাবস্থানের বিকল্প নেই।

প্রশ্ন হলো- আমরা ৯০ শতাংশ মুসলমানকে ৮ শতাংশ হিন্দুর সঙ্গে মিলেমিশে থাকার কথা বলি। কিন্তু ৩৮ শতাংশ ভোটার আওয়ামী লীগ, ৩৪ শতাংশ ভোটার বিএনপির সঙ্গে মিলেমিশে থাকার কথা কেন বলি না? অথচ বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাহরণ রয়েছে।

১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ৩২ বছর আগে স্বৈরাচারের পতনের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারা দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল কেন পরস্পর থেকে এতটা দূরে সরে গেল, সেটি খতিয়ে দেখা দরকার।

কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যা, তার চেয়ে বেশি বিভেদ রয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে। অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগের মধ্যেই বিভেদ তারও চেয়ে বেশি। বিশেষত পদবঞ্চিত নেতারা দলের সুবিধাভোগীদের প্রতিপক্ষ মনে করেন। মাঝে মাঝে এই বিভেদ প্রকাশ্যে চলে আসে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এমনকি আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা দলের প্রতিপক্ষের বদলে বরং বিএনপির কর্মী-সমর্থককে বিভিন্নভাবে সুবিধা দিয়ে থাকেন। এমনও দেখা গেছে- আওয়ামী লীগের সুবিধাপ্রাপ্তরা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার কৌশল হিসেবে নিজ দলের যোগ্য লোকদের দায়িত্ব দেওয়ার পরিবর্তে বিএনপির লোকদের জায়গা করে দিচ্ছেন; যাতে নিজ দলের প্রতিপক্ষ বা বিরোধীদের দমিয়ে রাখা যায়।

বলা যেতে পারে- জাতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পারস্পরিক লেনদেন না থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে একটি সমঝোতা আছে, যার ভিত্তি হলো- আর্থিক ও রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন। এ ধরনের 'সমঝোতা' গত এক দশকে অন্য মাত্রায় পৌঁছেছে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নয়- এরা হলো মূলত সুবিধাভোগী পক্ষ। বলা বাহুল্য যে- 'সুবিধাবঞ্চিত' রাজনীতিকদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কিছু ব্যক্তি যেমন আছেন, তেমনি বিএনপিরও অনেকে আছেন।

এই পরিস্থিতিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ সুযোগে সুবিধাভোগী পক্ষের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা বলছেন- আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসতে না পারলে শুধু ক্ষমতাসীনরা নন, রাজনৈতিক বিবেচনায় সুবিধাপ্রাপ্ত অন্যরাও সহিংস আক্রমণের শিকার হতে পারেন। সাধারণ বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও বুঝতে পারেন যে এটি বাস্তব নয়। বরং বাস্তবতা হচ্ছে- স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিকদের মধ্যে দলীয় বিরোধ থাকলেও অনেকেই পুত্র-কন্যা ও নাতি-নাতনির বিয়ে সূত্রে পরস্পরের আত্মীয়। আবার একই বাড়িতে ভাইবোন, চাচা-চাচি, মামা-মামি কিংবা অন্য কোনো সম্পর্কের মধ্যে এলাকার সব প্রধান দলের নেতাদের উপস্থিতি থাকে। রক্ত কিংবা সামাজিক সম্পর্কের আত্মীয়তার বাইরে যাঁরা থাকেন, তাঁদের আশ্রয় দেওয়াটাও অন্যরা কর্তব্য মনে করেন। ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে ওই দলের লোকসহ সুবিধাপ্রাপ্তরা আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ বাংলাদেশে নেই।

হ্যাঁ, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে পাতি নেতাদের মধ্যে কিছুটা সংঘর্ষ ও সংঘাত হবে। হয়তো রক্তও কিছু ঝরবে; যা এখনও কমবেশি দেখা যায়। এটি হবে মূলত ওইসব লোকের সঙ্গে, যাঁরা ক্ষমতা ব্যবহার করে অন্যের শারীরিক বা আর্থিক ক্ষতি করেছেন; হামলা-মামলা করেছেন। তবে ক্ষমতার পালাবদলে জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে প্রায় সারাদেশে যা ঘটবে তা হলো- অবৈধভাবে উপার্জিত নগদ অর্থসহ স্থাবর সম্পত্তির হাতবদল। ধরা যাক, সুবিধাভোগীর কেউ একজন সরকারি খাস জমিতে বাড়ি কিংবা মার্কেট বানিয়ে এখন ভোগ করছেন। ক্ষমতার পালাবদলে এ সম্পত্তি সোজা চলে যাবে নতুন ক্ষমতায় আসা ব্যক্তিদের হাতে। এমনকি ক্ষমতায় থেকে যাঁরা লুটপাট করেছেন, তাঁদের অর্থকড়ির বড় অংশই নতুন ক্ষমতাপ্রাপ্তরা আপসে নিয়ে যাবেন। তার বদলে যাঁরা ভয়াবহ রক্তারক্তির কথা বলেন, তাঁরা আসলে নিজেদের 'টাকা বানানোর মেশিন' হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা থেকেই বলেন।

এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ ছোট-বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে থাকা সৎ ও নির্ভীক রাজনীতিকদের পাশাপাশি দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিবেদিত পেশাজীবী সবার উচ্চকণ্ঠ হওয়া দরকার। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি ও দেশ গঠনের জন্য দাবি তোলা দরকার। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময় থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে নতুন ধরনের রাজনীতি প্রবর্তন ও লালন করে আসছে এবং ক্রমে যা সমাজের গভীরে বিস্তার লাভ করে দেশের সব প্রাতিষ্ঠানিকতা ভেঙে পড়েছে; সেই রাজনীতি যে মোটেই কল্যাণকর নয়- এটি এখন দিনের আলোর মতো সুস্পষ্ট ও সর্বজনবিদিত।

এ অবস্থায় দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ-বিএনপির নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন ও চর্চাকে বিচার-বিশ্নেষণ করে কীভাবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করা যায়, তা ভেবে দেখার এখনই উপযুক্ত সময়। উভয় দলের দিক থেকেই এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। এ কথা জনগণের সামনে সুস্পষ্ট করতে হবে- তারা আর যাই করুক, দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণবিরোধী কোনো কাজে আর জড়াবে না। বরং ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মত ও পথকে ধারণ করা সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের কল্যাণে যখনই দরকার হবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে। যেমনটি সবাই ১৯৭১ সালে করেছিল।

আমরা যাঁরা ৫০-এর কোঠায়, তাঁরা একটা সুন্দর ও সৌহাদপূর্ণ বাংলাদেশ দেখে যেতে চাই। আমাদের এ চাওয়াটা নিশ্চয়ই দোষের কিছু নয়?

মোহাম্মদ গোলাম নবী: লেখক, উন্নয়নকর্মী ও অনুবাদক