একদিকে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণভাবে বৃহৎ আমদানি দায় নিষ্পন্নের কারণে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। রিজার্ভ ধরে রাখতে নানা উদ্যোগের পরও অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচক নিম্নমুখী। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে, কমে গেছে রপ্তানি আয়। কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ; এমনকি বৈদেশিক ঋণও। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই কয়েক মাস ধরে বলে আসছেন- আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল তথা আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়া ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই। বিশ্বব্যাংক, এডিবি যদিও সাধারণভাবেই আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন করছে, আইএমএফের ঋণেই যেন সবার চোখ। প্রসঙ্গত, এক দশক আগে ভ্যাট আইন প্রণয়ন করার শর্তে বাংলাদেশ সাত কিস্তিতে আইএমএফ থেকে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের বর্ধিত ঋণ সুবিধা (ইসিএফ) পেয়েছিল।

ইতোমধ্যে রাজস্ব ও আর্থিক খাতের সংস্কার নিয়ে আলোচনা করতে বাংলাদেশে এসেছে আইএমএফের প্রতিনিধি দল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ও এডিবির কাছে ১০০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে বলে পত্রিকান্তরে জানা গেছে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের নিয়মিত বাজেট ও বিশেষ প্রকল্প সহায়তার ১০০ কোটি ডলারও রয়েছে।

সামগ্রিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় এই পরিমাণ ঋণ সহায়তা যথেষ্ট কিনা, তা নিয়ে যদিও উদ্বেগ রয়েছে; বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে আইএমএফের ঋণ দরকার হবে। সরকার সেদিকেই নজর দিয়েছে। আইএমএফও ঋণ দিতে চাইছে বলে জানা গেছে। একটি উদীয়মান বাণিজ্য অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশের ঋণ পাওয়ার অবস্থাও আছে। তবে এই ঋণ নিতে হলে কিছু শর্ত মানতে হবে।

সরকারের ভেতর ও বাইরের অনেককেই বলতে শুনেছি- অর্থনীতির সংকট সামাল দিতে আইএমএফের ঋণ খুবই জরুরি। যদি কিছু শর্ত মানতে হয়, সেটি মেনেও নিতে হবে। কারণ এ ঋণ আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করবে। আইএমএফ আমাদের ঋণ দিলে বিশ্বব্যাংকও পাশে থাকবে ও ঋণ দেবে। এডিবি, জাইকাসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাও হয়তো এগিয়ে আসবে।

সম্প্রতি আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বৈঠকে যোগদান শেষে দেশে ফিরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আইএমএফের সম্ভাব্য ঋণের শর্তাবলি সম্পর্কে কিছুটা ধারণাও দিয়েছেন। এগুলো হলো- রাজস্ব প্রশাসনের আধুনিকায়ন, রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা, জিডিপি অনুপাতে কর আদায়ের পরিমাণ বাড়ানো, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং মন্দ ঋণ কমানো।

বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে সরকার ইতোমধ্যেই বাস্তবায়ন জরুরি নয়- এমন সব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ স্থগিত রেখেছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অতি প্রয়োজনীয় ছাড়া আমদানির ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। অবশ্য এটি করতে গিয়ে চাল, গম ও ডালের মতো খাদ্যশস্য আমদানি কমে গেছে। সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে।

দেশের চাহিদা পূরণে চলতি অর্থবছরে অন্তত এক কোটি টন গম ও চাল আমদানির প্রয়োজন হবে মনে করা হলেও শুধু চাল ও গম নয়, কমেছে ডাল আমদানিও। এমন সময়ে দেশের প্রধান তিন খাদ্যশস্য আমদানি কমছে, যখন আগামী বছরে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, খাদ্য ও কৃষি সংস্থাসহ খোদ আইএমএফ।

খাদ্যশস্য আমদানিকারকের সংখ্যাও কমেছে। পাম অয়েল, সয়াবিন তেল ও চিনিতে যেমন গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, খাদ্যশস্যে তা নেই। ছোট থেকে বড় ব্যবসায়ীরা খাদ্যশস্য আমদানি করেন। ধারণা করা হচ্ছে, ডলার সংকটে ব্যাংকে ঋণপত্র খুলতে না পারায় ছোট ব্যবসায়ীরা আমদানি করতে পারছেন না।

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুই খাত প্রবাসী আয় ও পণ্য রপ্তানিতেও সুখবর নেই। গত মাসে একসঙ্গে দুই খাতের আয় কমেছে। চলতি মাসেও পণ্য রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় ফেরার সম্ভাবনা কম। কারণ, সামগ্রিক রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশের জোগানদাতা তৈরি পোশাকশিল্পের রপ্তানি চলতি মাসের প্রথম ২০ দিনে ১৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমেছে। চলতি মাসের প্রথম ২০ দিনে (১ থেকে ২০ অক্টোবর) ১৭৭ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ কম। গত বছরের অক্টোবর মাসের প্রথম ২০ দিনে রপ্তানি হয়েছিল ২১৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক।


অক্টোবর মাসের প্রথম ২০ দিনে দেশে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১১০ কোটি মার্কিন ডলার। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মাস শেষে প্রাক্কলিত প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ১৭০ কোটি ডলার। যদিও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে বিভিন্ন ছাড় দেওয়া হয়েছে, তবু গতি বাড়েনি। চলতি অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে ১৫৪ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এ অঙ্ক গত সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। অবশ্য অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে মাসপ্রতি দুই বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পরিমাণের রেমিট্যান্স এসেছে।

বিদেশি ঋণ আসাও কমে গেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে মোট ১৩৪ কোটি ৯২ লাখ ডলারের ঋণ সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এ অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ দশমিক ৩৮ শতাংশ কম। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের এই তিন মাসে ১৯৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের ঋণ ছাড় করেছিল দাতারা।

অবশ্য গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় বিদেশি ঋণপ্রবাহের উল্লম্ম্ফন নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২২-২৩ অর্থবছর। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রায় ৪৯ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ সহায়তা এসেছিল, যা ছিল গত জুলাইয়ের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। কিন্তু দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসে হোঁচট খায়। ওই মাসে ৩৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলারের ঋণ ছাড় করে দাতারা, যা ছিল আগের মাস জুলাইয়ের চেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ কম। সেপ্টেম্বরে এসেছে ৪৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলার।

বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রায় সবাই বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্বমন্দা বিবেচনায় বহুজাতিক ও দ্বিপক্ষীয় সব বিদেশি ঋণ ও সহায়তা কমবে। আইএমএফের ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন (যেটা পেতে এমনকি মার্চ হয়ে যেতে পারে), বিশ্বব্যাংক ও এডিবির আরও প্রায় দুই বিলিয়ন এক করলেও আমাদের প্রাক্কলিত আমদানি এমনকি অন্যান্য বিদেশি দায় মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট নয়। আমাদের স্বাভাবিকভাবেই নজর থাকতে হবে রপ্তানি, প্রবাসী আয়, বিদেশি বিনিয়োগ এবং দ্বিপক্ষীয় বিদেশি সহায়তার দিকে। তবে সেগুলো নিশ্চিত করতে গেলে আমাদের অবশ্যই স্থানীয় রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, রপ্তানিতে প্রণোদনা ও জ্বালানি সহায়তা, সরকারের খরচ কিংবা অপচয় কমানো এবং আর্থিক খাতের সেবার পরিধি বৃদ্ধি ও সরকারের সামগ্রিক ব্যয় শৃঙ্খলার ওপর জোর দিতে হবে। রাজস্ব আয়ের পরিধি বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা আনতেও প্রণিধানযোগ্য উদ্যোগ নিতে হবে।

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্নেষক