ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং সোমবার সন্ধ্যায় যখন চট্টগ্রাম ও বরিশাল উপকূলে আছড়াইয়া পড়ে তখন উহার গতিবেগ ছিল ৭৪ কিলোমিটার। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, একই রাত্রে ঢাকা নগরীর উপর দিয়া বহিয়া গিয়াছিল ৫০ কিলোমিটার গতিতে, যাহার ধাক্কা সহ্য করিবার ক্ষমতা যে কোনো ভবনেরই থাকার কথা। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, ঐ বায়ু প্রবাহেই ঢাকার পার্শ্ববর্তী কেরানীগঞ্জের দুইটা ভবন হেলিয়া পড়িয়াছে। শনিবার সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, কেরানীগঞ্জের শুভাড্যা ইউনিয়নের হাজিনগরের একটা পাঁচতলা ভবন এবং ইহার নিকটবর্তী এলাকার অপর একটা চারতলা ভবন হেলিয়া পড়িয়াছে। আরও বিস্ময়কর হইল, কোনো ভূমিকম্প বা ভূমিধস ব্যতিরেকেই কেরানীগঞ্জে গত পাঁচ বৎসরে অন্তত ছয়টা ভবন হেলিয়া পড়িয়াছে বলিয়া জানা গিয়াছে। এলাকাবাসীর বরাত দিয়া প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, ঐ এলাকায় পুকুর ও খালের পাড়ে কোনো রকম পাইলিং বা নির্মাণবিধির ধার না ধারিয়া নিছক কয়েকটা পিলারের উপর তিন হইতে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা হইয়াছে। এই ধরনের ভবন যে টেকসই হইতে পারে না উহা বুঝিবার জন্য কাহারও বিশেষজ্ঞ হইবার প্রয়োজন রহিয়াছে বলিয়া আমাদের মনে হয় না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তথা রাজউক এবং স্থানীয় প্রশাসন হয় বিষয়টার ভয়াবহতা বুঝিতে পারিতেছে না অথবা বুঝিয়াও রহস্যজনক কোনো কারণে উপেক্ষা করিয়া যাইতেছে। যেমন, সোমবারের দুর্ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসন অকুস্থলে যাইয়া ভবন দুইটা হইতে ভাড়াটিয়াদের সরাইয়া লইতে সংশ্নিষ্ট মালিকদের নির্দেশ প্রদান করে; কিন্তু, প্রতিবেদন অনুসারে, শুক্রবার পর্যন্ত সেই নির্দেশ পালিত হয় নাই। উপরন্তু, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ঘটনা তদন্তের জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করিলেও তাহাদের কোনো তৎপরতাই আরম্ভ হয়নি। আর রাজউকের অনুমোদন ব্যতিরেকে কেরানীগঞ্জে কোনো ভবন নির্মাণ বেআইনি হইলেও সেখানকার অধিকাংশ ভবন মালিক ইহার প্রয়োজন বোধ করে নাই; রাজধানী ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের ভবন নির্মাণবিষয়ক নিয়ন্ত্রক সংস্থাটিরও এই বিষয়ে কোনো হেলদোল দৃশ্যমান নহে।

স্বীয় দায়িত্ব পালনে রাজউকের এই উদাসীনতা শুধু কেরানীগঞ্জেই নহে, খোদ রাজধানীতেও প্রকটরূপে পরিলক্ষিত। প্রথমত, ঢাকা শহরের বহু এলাকায় বিশেষ করিয়া ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ও নিম্নাঞ্চলসমূহে চোখের সামনে রাতারাতি অনুমোদনহীন ভবন উঠিতে দেখিয়াও রাজউক দৃশ্যত বিচলিত নহে। দ্বিতীয়ত, নকশার অনুমোদন লইলেও ভবন নির্মাণের সময় খুব সামান্য মালিকই উহা মানিয়া চলে; খুব সামান্য ক্ষেত্রই আছে যেখানে রাজউক ঐ ব্যত্যয়ের জন্য নির্মাণকাজ বন্ধ করিয়া দিয়াছে। নির্মাণকাজ সম্পন্ন করিয়া ভবন ব্যবহারের নিমিত্তে রাজউকের অনুমতি লইবার বিধান থাকিলেও তাহা প্রতিপালিত হওয়ার হার শূন্যের কাছাকাছি বলিলে ভুল হইবে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সংবাদমাধ্যমে রাজউকের এহেন দায়িত্বহীনতা লইয়া প্রতি বৎসর বহু প্রতিবেদন প্রকাশিত ও সম্প্রচারিত হইলেও পরিস্থিতির ইতরবিশেষ ঘটিতেছে না। অভিযোগ রহিয়াছে, রাজউক কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতির দায় তাহাদের জনবল সংকটের উপর ফালাইতে চেষ্টা করিলেও ঐ নির্মাণবিধিসমূহের ব্যত্যয়কারী ভবন মালিকদের সাথে রাজউকের অসাধু কর্মীদের অশুভ আঁতাতই মূলত ইহার জন্য দায়ী। কেরানীগঞ্জের ভবন মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার নেপথ্যেও যে একই বিষয় কাজ করিতেছে না তাহা কেহ নিশ্চিতভাবে বলিতে পারে না।

শুভাড্যার ঐ হেলিয়া পড়া ভবন দুইটার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মানুষ হতাহত না হইলেও এলাকাবাসীর আশঙ্কা, ভবনগুলি অবিলম্বে খালি না করা হইলে যে কোনো সময় বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটিতে পারে। তাই রাজউকের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনকে অতিসত্বর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবার জন্য আমরা আহ্বান জানাইতেছি। একই সাথে ঐ এলাকায় আরও যেইসব নড়বড়ে ভবন রহিয়াছে সেইগুলি চিহ্নিত করিয়া হয় টেকসইভাবে পুনর্নির্মাণ নতুবা 'রেট্রোফিটিং' করিবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলিয়া আমরা মনে করি। মনে রাখিতে হইবে, একদিকে পুরা দেশটাই দুর্যোগপ্রবণ, আরেকদিকে ঢাকা ও ইহার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ রহিয়াছে ভূমিকম্পের শঙ্কার মধ্যে। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হইলে যে কোনো সময় জানমালের বড় রকমের বিপর্যয় ঘটিতে পারে। তবে রাজউকের ন্যায় নির্মাণকাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহকে দায়িত্ব সচেতন করিয়া তোলা গুরুত্বপূর্ণ সর্বাগ্রে।

বিষয় : নিছক ঔদাসীন্য নহে সম্পাদকীয়

মন্তব্য করুন