
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি' উপন্যাসে শহর থেকে দূরে নদী এলাকার কয়েকটি গ্রামের দীন-দরিদ্র জেলে ও মাঝিদের জীবনচিত্র অঙ্কিত হয়েছে। জেলেপাড়ার মাঝি ও জেলেদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, অভাব-অভিযোগ- যা কিনা প্রকৃতিগতভাবে সেই জীবনধারায় অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তা এ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে। রোববারে সমকালে 'দুর্দশা ঘোচেনি অসংখ্য জেলের' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনটি যেন সেই উপন্যাসের বর্তমান প্রতিচ্ছবি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ৮৮ বছর আগে পদ্মা নদীর মাঝি রচনা করেছেন। এ উপন্যাসের পটভূমি বিক্রমপুর-ফরিদপুর অঞ্চল। সে সময়ের বিক্রমপুর তথা বর্তমান মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও বৃহত্তর ফরিদপুরের শরীয়তপুর জেলার জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতু হয়েছে। উভয় পাড়ের মানুষের নদী পারাপারের কষ্ট লাঘব হয়েছে। কিন্তু জেলেদের ভাগ্য বদলায়নি। সাম্প্রতিক ঘুর্ণিঝড় সিত্রাং জেলের সংকট আরও বাড়িয়েছে। এমনিতেই ঋণের ফাঁদের বন্দিদশা জেলেদের নির্দিষ্ট গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসতে দিচ্ছে না। ফলে দিন-রাত উত্তাল সাগর কিংবা নদীতে মাছ শিকার করেও অভাব ঘোচাতে পারছেন না তাঁরা।
পদ্মার মতোই মেঘনা, যমুনা, ইলিশা, মাসকাটা, তেঁতুলিয়া, কালাবদর, কীর্তনখোলা প্রভৃতি নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করছে দেশের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী। নদীর পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার করে জীবন ধারণ করা জেলেদের সংখ্যাও কম নয়। তাঁদের শিকার করা সামুদ্রিক মাছের আলাদা কদর রয়েছে। নদী থেকে ইলিশ, পাঙাশ, বোয়াল, পোয়া, বেলে, বাটা, টেংরাসহ হরেক রকমের মাছ শিকার করা হলেও ইলিশের ওপর তাঁদের নির্ভরতা বেশি। পদ্মার ইলিশের যশ বেশি হলেও মেঘনার ইলিশ না হলে চলেই না। চাঁদপুরের পাশাপাশি বঙ্গোপসাগর-মেঘনার মোহনায় ইলিশের ছড়াছড়ি বেশি। নদীতে জোয়ার-ভাটার বিষয় রয়েছে; ২৪ ঘণ্টাই মাছ শিকার করা যায় না। তাই সুবিধাজনক সময় বুঝে জাল-নৌকা নিয়ে নদীতে নামেন জেলেরা। এ সুবিধাজনক সময়কে মেঘনাপাড়ের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় 'জোবা'। অর্থাৎ তাঁরা জোবা বোঝে কোপ মারেন। ভাটি অঞ্চলে বেশি মাছ ধরা পড়ায় জেলেরা বছরের একটা সময় ৩-৪ মাসের জন্য ভোলার চরফ্যাসনে চলে যান।
জেলেদের ভাগ্য বদল না হওয়ার জন্য ঋণের ফাঁদের কথা আগেই বলেছি। ঋণকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় 'দাদন'। পুরোনো আমলের মহাজন প্রথা না থাকলেও জেলেরা দাদন থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি। জেলেদের শিকার করা মাছ বিক্রির জন্য নদীর তীরে রয়েছে অসংখ্য বিক্রয়কেন্দ্র। এগুলোকে স্থানীয় ভাষায় ঘাট বলা হয়। মাছের এসব ঘাট সরকার থেকে বার্ষিক হিসেবে ইজারা নেওয়া হয়। ইচ্ছা করলেই এসব ঘাটের ইজারাদার হওয়া যায় না। এ জন্য টাকার পাশাপাশি যে নিয়ামকগুলো কাজ করে সেসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদ, ক্ষমতাসীন দলের হলেও গ্রুপিংয়ে মাঠ দখলে থাকাদের সমর্থন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাঠিয়াল বাহিনী। যদিও ইদানীং এক ঘাটের সঙ্গে আরেক ঘাটের সংঘর্ষে লাঠির বদলে দেশীয় অস্ত্রের মহড়া দেখা যায়। জেলেরা অসংখ্য ঘাটের মধ্যে নির্দিষ্ট ঘাটে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য থাকেন। এর দুটি কারণ রয়েছে- সংশ্নিষ্ট ঘাটের ইজারাদার থেকে দাদন নেওয়া এবং ওই ইজারাদারের রাজনৈতিক প্রভাব। ইজারাদারদের পাশাপাশি আড়তদাররাও দাদন দেন। ফলে ঘাটে নির্ধারিত পাইকারের কাছে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য থাকেন জেলেরা। দরকষাকষি কিংবা একাধিক ঘাট যাচাই-বাছাই করে বিক্রির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন দাদন নেওয়া জেলেরা। চাঁদপুর ও ভোলা থেকে লঞ্চের নিচতলা ভর্তি করে ঝুড়ি ঝুড়ি মাছ ঢাকায় এনে লাভের টাকা গুনছেন পাইকার ও আড়তদাররা।
পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে মাছ শিকারের নিষিদ্ধ মৌসুম বলে কিছু পাওয়া যায়নি। সময়ের ব্যবধানে মৎস্য খাত নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে। ফলে সাগর থেকে নদীতে ডিম ছাড়তে আসার সময় মা ইলিশ শিকার নিষিদ্ধ করেছে সরকার। প্রজনন মৌসুমে এটি করার কারণে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া জাটকা (২৩ সেন্টিমিটারের ছোট ইলিশ) নিধন রোধেও নিষিদ্ধকাল নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এসব ভালো উদ্যোগ। আরও ভালো উদ্যোগ হলো, মাছ শিকার নিষিদ্ধকালীন জেলেদের অর্থ ও খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে সরকার। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, এসব সহায়তা পান না অনেক প্রকৃত জেলে।
সরকারি নিষেধাজ্ঞা মেনে বেশিরভাগ জেলে মাছ শিকারে বিরত থাকলেও কতিপয় দাদন ব্যবসায়ীর চাপে কোনো কোনো জেলেকে বাধ্য হয়ে নদীতে নামতে হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দেওয়া আগুনে জালে যখন আগুন জ্বলে, তখন জেলেদের চোখের অশ্রুতেও আগুন জ্বলে। দাদনের ঘানিও তাঁদের টানতে হয়, জাল পোড়ার দৃশ্য দেখতে হয়, নীরবে সহ্য করতে হয়। কখনও কখনও কারাগারেও যেতে হয়। নিষেধাজ্ঞার সময় বাদে সারাবছর জেলেরা নদীতে জাল পাতলেও সব সময় আশানুরূপ মাছ মেলে না। ফলে পাঁচ-সাতজন জেলের ১২-১৪ ঘণ্টা শ্রম দিয়ে সেই সময়ে শিকার করা মাছ বিক্রি করেও ইঞ্জিনচালিত নৌকার ডিজেলের খরচ ওঠে না। এরপরও পেশার প্রতি সম্মান ও রুটি-রুজির তাগিদেই ঝড়-তুফান উপেক্ষা করে নদীতে নামেন তাঁরা।
২৮ অক্টোবর শেষ হয় মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। ২৪ অক্টোবর রাতে উপকূলীয় এলাকায় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে নোঙর করা নৌকাডুবির খবর সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। নিষেধাজ্ঞা শেষে যখন নতুন স্বপ্ন বুনছিলেন, তখন এ ঝড় অনেক জেলের জীবনে নিয়ে এসেছে হতাশা। এ অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলেদের পাশে দাঁড়ানো সরকারের দায়িত্ব। একই সঙ্গে দাদন, মাছঘাট, পাইকার, আড়তদারের শোষণ থেকে মুক্তি দেওয়া প্রয়োজন। এ জন্য সহজ শর্তে ঋণের পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতিতে সংস্কারের বিকল্প নেই।
বিষয় : নদীর মাঝি দরিদ্র জেলে মিজান শাজাহান
মন্তব্য করুন