গত ২৩ অক্টোবর একাধিক রাজনৈতিক দল দেশব্যাপী উপজেলা দিবস পালন করেছে। দেশে উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল এরশাদের সামরিক শাসনের অধীনে। উপজেলাকে কেন্দ্র করে দেশের প্রশাসন ঢেলে সাজানো হয়। জেলায় বিদ্যমান প্রায় সব সরকারি দপ্তর উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়। উপজেলায় চালু করা হয় সরকারি হাসপাতাল, অধস্তন আদালত; এমনকি সাবজেলও। কিন্তু উপজেলা পরিষদের দ্বিতীয় নির্বাচনে চেয়ারম্যানদের মেয়াদপূর্তির আগেই গণআন্দোলনে এরশাদের পতন হয়। সংসদীয় ব্যবস্থার নতুন সরকার দেশের সব উপজেলা ও উপজেলা পরিষদ বাতিল করে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে চার স্তরের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালুর উদ্যাগ নেয়। পর্যায়ক্রমে স্থানীয় সরকার (গ্রাম পরিষদ) আইন, উপজেলা পরিষদ আইন ও জেলা পরিষদ আইন প্রণয়ন করা হয়। ইউনিয়নের জন্য বিদ্যমান ইউনিয়ন পরিষদ অধ্যাদেশ কার্যকর ছিল। দেশ প্রবেশ করে চার স্তরের স্থানীয় সরকারের যুগে। যদিও অনেক বছর জেলা-উপজেলায় কোনো পরিষদ নির্বাচন হয়নি। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় সরকার (গ্রাম পরিষদ) আইন ১৯৯৭ বাতিল করে প্রণয়ন করে গ্রাম সরকার আইন ২০০৩। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার এ আইনটি বাতিল করে। ইউনিয়ন পরিষদ একমাত্র স্থানীয় সরকার, যা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলমান।

বর্তমানে ১৯৯৮ সালে প্রণীত উপজেলা পরিষদ আইন কার্যকর রয়েছে। এ আইনের অধীনে উপজেলা পরিষদগুলোর তৃতীয় মেয়াদ চলছে। সংবিধান অনুযায়ী প্রশাসনিক একাংশ ঘোষিত বর্তমান উপজেলার সঙ্গে এরশাদের উপজেলার মূল পার্থক্য হলো, আগে একজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতেন; বর্তমানে একজন চেয়ারম্যান ও দু'জন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তবে ক্ষমতায় রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। আগে উপজেলা চেয়ারম্যানরা (এমনকি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও, যিনি মূলত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান) ইউএনওদের এসিআর লিখতেন। তবে কোনো সময়ই উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ পরিষদ ছিল না। নামে পরিষদ হলেও উপজেলা পরিষদে আর কোনো সদস্য আগেও নির্বাচিত হতেন না; এখনও হন না।

দেশের ৮০টিরও বেশি সংসদীয় আসন একটি মাত্র উপজেলা নিয়ে গঠিত। অর্থাৎ ওইসব আসন বা উপজেলার একই ভোটাররা এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং দুই ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচন করেন। আরও শতাধিক আসনে রয়েছে একটি উপজেলার প্রাধান্য। তাই নিজের ভোটারদের ওপর প্রভাব ঠিক রাখতে এমপিরা উপজেলা পরিষদ কার্যকর হতে দেবেন না- এটাই স্বাভাবিক। বর্তমান আকার, আয়তন ও নির্বাচন পদ্ধতিতে উপজেলা পরিষদ কার্যকর হবে না- এটি নিশ্চিত। আবার এমপিরা তাঁদের মূল দায়িত্ব জাতীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারছেন না ঘর সামলাতে ব্যস্ত থাকায়। সুযোগ পেয়ে জাতীয় ও স্থানীয় উভয় ক্ষেত্রেই আমলারা প্রাধান্য বিস্তার করেছেন।

শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা ও সংসদ সদস্যদের জাতীয় নীতিনির্ধারণে আরও বেশি যুক্ত করতে উপজেলা পদ্ধতির সংস্কার অপরিহার্য। দেশে বিভাগ নামে আরেকটি স্তর রয়েছে, যা মূলত সরকার ও জেলার মধ্যবর্তী তদারকি স্তর। এটি কোনো স্থানীয় সরকার বা সংবিধান অনুযায়ী প্রশাসনিক একাংশ নয়। তেমনি জেলা ও ইউনিয়নের মধ্যবর্তী উপজেলাকে তদারকি স্তর হিসেবে রাখা যায়। জেলা পরিষদের সব কার্যক্রম উপজেলায়ও থাকবে এবং জেলা পরিষদ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হবে। জেলা পরিষদ এবং বর্তমানে উপজেলা পরিষদে হস্তান্তরিত সব কার্যক্রম জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। উপজেলা হবে জেলার অধস্তন এবং ইউনিয়নের তদারকি স্তর। সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ক্ষমতা প্রদান করে ঢেলে সাজালে জেলা ও ইউনিয়ন (শহরে পৌরসভা) দুই স্তরের টেকসই, গতিশীল ও জনবান্ধব স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। একই সঙ্গে সংসদ সদস্যরা জাতীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারণে আরও বেশি মনোযোগী হতে পারবেন। সর্বোপরি প্রজাতন্ত্রে জনগণের মালিকানা অধিকতর নিশ্চিত হবে।

সালেহিন চৌধুরী শুভ: নির্বাহী পরিচালক, হাউস
salehinhaus@gmail.com