
আনোয়ারা সৈয়দ হক জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯৪০ সালের ৫ নভেম্বর, যখন যশোর জেলার চুড়িপট্টি গ্রামটি কার্তিকের কুয়াশা কাটিয়ে জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। পিতা রফিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন ব্যবসায়ী। মা আছিয়া খাতুন গৃহিণী। শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন তিনি যশোরের শ্যামল প্রকৃতির হাতে হাত রেখে। দু'চোখে নিসর্গের নির্মল আলো মেখে বিস্ময়ে তাকিয়েছেন মহাপৃথিবীর সব নতুনত্বে। চুড়িপট্টির মোহনগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন মায়ের হাতে প্রথম পাঠ নিয়ে। মধুসূদন তারাপ্রসন্ন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক ও ১৯৫৮ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্কুল ও কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেছিলেন জ্ঞান অর্জনের অপার অনুরাগে। উনিশ শতকে এই মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মেছিলেন যশোরের 'দুগ্ধস্রোতরূপী' কপোতাক্ষ নদের পাড়ে সাগরদাঁড়ী গ্রামে, যিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক শিল্পী, বাংলা কাব্যের প্রাণপুরুষ। প্রতিভাধর যশোরের মাটি ধারণ করেছে বহু কৃতী সন্তান।
ইংরেজি সাহিত্য পাঠের দুর্মর আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও বাবার আগ্রহে ১৯৫৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন এ মেধাবী। সুশ্রী, সুন্দরী, বিদুষী, প্রিয়দর্শিনী মেয়েটি জীবনসংগ্রামের দলিল হাতে নিয়ে ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস পাস করেছিলেন মানবসেবার অঙ্গীকার নিয়ে। সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মানবসেবার পাশাপাশি সাহিত্য সৃষ্টির সুগভীর প্রেরণা ও আকুতি থেকে শব্দে শব্দে নিরন্তর সৃষ্টি করে গেছেন নিজস্ব প্রত্যয়ের এক ভিন্নধর্মী শৈল্পিক রসমূর্তি। উপন্যাস, ছোটগল্প, শিশুতোষ, প্রবন্ধ, ভ্রমণকথা, স্মৃতিকথা ছাড়াও কাব্যশিল্পে অলৌকিক মায়াস্রোতে অবগাহন করেছেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়।
৮২ বছরের ঋদ্ধ সময়তরীতে ভাসিয়ে দিয়েছেন তিনি শিল্পের অমৃত ভেলা। দীর্ঘদিন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় আপন প্রতিভার স্বাক্ষরে তিনি ঢেলে দিয়েছেন শিল্পের সোনালি মুদ্রা যত। শুভ জন্মদিন আপনাকে, আনোয়ারা সৈয়দ হক। হে বরেণ্য বাংলা ভাষার শিল্পী, কথাশিল্পী।
শুভ জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই আপনাকে আজ। উইকিপিডিয়ায় আপনার পরিচিতি প্রসঙ্গে লেখা আছে- আনোয়ারা সৈয়দ হক হলেন একজন খ্যাতনামা বাংলাদেশি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক। তিনি বেশ কিছু গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও শিশুসাহিত্য রচনা করেছেন। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর রচনায় মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো তুলে ধরেছেন। উপন্যাসে অবদানের জন্য তিনি ২০১০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। পারিবারিক জীবনে তিনি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সহধর্মিণী।
আপনাকে যেটুকু পাঠ করেছি, তা থেকে অনুমান করি, ব্যক্তিজীবনের চরৈবেতি এবং তার শত-সহস্র বিষাক্ত হুলের নীল বেদনা অনেকটাই আপনি রচনার সুকৌশল বর্ণনার ভেতরে কুয়াশার এক বনায়ন সৃষ্টি করে বলতে চেষ্টা করেছেন। কখনও সরাসরি, কখনও বা রূপকের আধারে; কখনও বাদ-প্রতিবাদে, ক্ষোভ-বিক্ষোভে, ক্ষুব্ধ সংলাপে।
প্রয়োজনে স্পষ্ট আর্তচিৎকারে বলেছেন আপনারই কথা বিভিন্ন চরিত্রের মুখে। সবই তো আপনার জীবনদর্শন থেকেই উদ্ভূত, সংকলিত। আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, অসামান্য আপনাকে পরিপূর্ণভাবে পাঠ করে শেষ করতে পারিনি এই সামান্য আমিও। ১৯৫৪ সালে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় আপনার ছোটগল্প 'পরিবর্তন' প্রকাশের মধ্য দিয়েই প্রথম সাহিত্যযাত্রা। সাহিত্যকে ভালোবাসার প্রমাণ। সৃষ্টিশীল এষণায় দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার।
১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সাল ইত্তেফাকের কচি-কাঁচার আসরে নিয়মিত লিখে হাত পোক্ত হয়েছে নিঃসন্দেহে। এ ছাড়া শুরুতে স্কুল-কলেজ, এমনকি মেডিকেলের জার্নালেও ছড়িয়ে আছে আপনার সাহিত্যচর্চার বর্ণিল স্বাক্ষর। ১৯৬২-৬৩ সালের দিকে তরুণ লেখক সৈয়দ শামসুল হকের 'তিন পয়সার জ্যোছনা' কিনে পাঠ করে মুগ্ধ হলেন। এতটাই মুগ্ধ হলেন, সে আবেগের কথা লেখককে চিঠি লিখে জানালেন নির্দি্বধায়, অকপটে। সেই পাঠসূত্রের স্পর্শে এলো চিঠি। হেমন্তের ঝরাপাতার মতো উড়ে উড়ে এসে জমলো অনেক। পাহাড় হলো, নদী হলো, আকাশের নীল হলো; কিছু নক্ষত্র হয়ে উড়তে শুরু করে দিল আপনার উন্মুখ হৃদয়াকাশের গভীর নীলে। অতঃপর গুলিস্তান সিনেমা হলের চিনচাও চায়নিজ রেস্তোরাঁয় দু'জনের দেখা হলো তৃষা হরিয়ে। এক দেখায় প্রেমের প্রণতি ও অভিবাদন জানিয়ে যে শব্দবন্দনা রচনা করলেন কবি; কবিতার সেই অলৌকিক মায়ার জগতে প্রবেশমাত্রই বিমোহিত হলেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের শাশ্বতী কবিতার মতো একদা বাদল শেষের রাতে যেন হাতে হাত রেখে মূর্ত হলেন দু'জন দু'জনার মর্মতলে। থেমে গেল কালের চিরচঞ্চল গতি। আপনার মনোভূমি কবিতার সমুদ্রজলে ভিজে কাদা কাদা হলো সবুজ শস্যক্ষেত সৃষ্টির অভিপ্রায়ে। তা ছাড়া কবিকে ভালো না বেসে কি আর সেই মহামুক্তি মেলে! প্রজাপতি ডানায় উড়ে উড়ে কেটে গেল অনেকটা সময়। ইতোমধ্যে সময়ের নিরিবিলি চূড়ায় জেগে উঠল অবিনাশী সেই প্রেম। বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে সে প্রণয় রূপকথা ১৯৬৫ সালে খুঁজে পেল তার গৃহ। নিভৃত বনমধ্যে যেন ছায়াচ্ছন্ন এক বহুবর্ণিল পুষ্প উদ্যান। দু'জনের অপার ভালোবাসায় এই ধরায় এসেছে দুই সন্তান- কন্যা বিদিতা সৈয়দ হক, পুত্র দ্বিতীয় সৈয়দ হক। আরও জন্ম নিল অমৃতের কতিপয় সন্তান। পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস 'তৃষিতা'।
দিলারা হাফিজ: কথাসাহিত্যিক
মন্তব্য করুন