পনেরো বছর আগে ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর শীতের এক বিকেলে রাওয়ালপিন্ডির এক নির্বাচনী সমাবেশ শেষে গাড়িতে ওঠার সময় পাকিস্তানের তৎকালীন জনপ্রিয় রাজনীতিক বেনজির ভুট্টো আততায়ীর গুলিতে মারা যান। যে নির্বাচনে তাঁর জয়লাভ করার কথা; তার এক সপ্তাহ আগে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটে। বৃহস্পতিবার বিকেলে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশটির তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির চেয়ারম্যান ইমরান খানকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার খবর যখন পাই, তখন বেনজির ভুট্টোর সে হত্যাকাণ্ড এবং তার পূর্বাপর স্মরণ করা কঠিন ছিল না। ইমরান খান বর্তমানে নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের অন্যতম জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বৃহস্পতিবার আগাম জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে দ্বিতীয় দফা লংমার্চ চলাকালে পাঞ্জাবের ওয়াজিরাবাদে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হলে গুলি তাঁর পায়ে লাগলেও এ ঘটনায় একজন নিহত ও আহত হয়েছেন কয়েকজন। তবে বেনজির ভুট্টোর ওই হত্যাকাণ্ডের আগমুহূর্তেও মনে হচ্ছিল, পাকিস্তান বুঝি দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। তাঁর হত্যার পর মনে হয়েছিল, স্থিতিশীলতা অর্জনের পথ আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে দেশজুড়ে টানা বিক্ষোভের ঘোষণা দিয়েছে ইমরান খানের দল পিটিআই।

ইমরান খানের ওপর হামলা সেটিই বলছে; পাকিস্তানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যেন সুদূর পরাহত। ইমরান খানকে এ বছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে উৎখাত করা হয়। পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে তিনি হেরে যান। হেরে যাওয়ার পেছনে ইমরান খানের সমর্থকরা দেশটির সব শক্তিশালী পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। এখন এক নেতাকে হত্যাচেষ্টা তাদের ক্রোধের জন্য যথেষ্ট। যার কারণে দীর্ঘমেয়াদে শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে। ইমরান খানকে হত্যাচেষ্টাকারী বা সন্দেহভাজন আততায়ীর তথ্য পাকিস্তানি মিডিয়ায় ছড়িয়ে আছে। এর পরও সেখানে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব আওড়ানো হচ্ছে এবং তা ইতোমধ্যে দেশজুড়ে গ্রহণ করা হয়েছে। এর আগে বেনজির ভুট্টোকে কারা হত্যা করেছে; পাকিস্তানিরা তা জানে না। এমন পরিস্থিতিতে সত্য হলেও লোকে যে কোনো সরল ব্যাখ্যাকে সন্দেহের চোখে দেখে। ইমরান খানের সমর্থকরাও দোষ দেওয়ার জন্য কাউকে খুঁজে বের করবে। ইতোমধ্যে দেশজুড়ে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতার অনেক প্রতীক ওরা ভেঙে ফেলেছে।


পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ইতোমধ্যে ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার খেলা শুরু করেছে। এক সপ্তাহ আগে পাকিস্তানের গোয়েন্দাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আনজুম এক অভূতপূর্ব সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি বারবার এ বিষয়টির ওপর জোর দিচ্ছিলেন- সামরিক বাহিনী রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ। তাঁর ভাষায়, ইমরান খান হিপোক্র্যাট। তিনি নাকি গোপনে সেনাবাহিনীর কাছে 'অসাংবিধানিক' এক প্রস্তাব করেছেন। এর আগে দেশটির গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানের এমন ভূমিকা দেখা যায়নি। ক্ষমতা ছাড়ার আগে-পরে ইমরান খান যখন সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে নানা বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন; তার প্রতিক্রিয়াতেই বলা চলে এই সংবাদ সম্মেলন। এর জবাবে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, নতুন প্যান্ডোরার বাক্স খোলা হয়েছে।

এই মাসের শেষে পাকিস্তানে নতুন সেনাপ্রধান আসার কথা। এটি দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী পদ। পাকিস্তানের বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার অবসরের তারিখ ২৯ নভেম্বর। বাড়তি মেয়াদে দায়িত্ব পালন না করে যথাসময়েই তাঁর অবসরে যাওয়ার কথা। বলা হচ্ছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশটির রাজনীতিতে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করবে না। ইমরান খানের ওপর হামলার ঘটনা দেশটির মধ্যে একটি বিভাজনের বীজ বপন করবে। আমাদের মধ্যে অনেকে দীর্ঘদিন ধরে ভবিষ্যদ্বাণী করে আসছেন, যে সময় পাকিস্তানিরা সামরিক প্রভাবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে, সে সময় দেশটির গণতন্ত্র যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং অর্থনৈতিক উন্নতি আরও ত্বরান্বিত হবে। এ ক্ষেত্রে ইমরান খানের ইসলামী ও পশ্চিমাবিরোধী বয়ান কতটা কাজে দেবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

ইমরান খানের সমর্থকরা হয়তো বলছে, পশ্চিমা বিশ্ব কিংবা বিশ্বের অন্য কোনো দেশের প্রগতিশীলরা কী বলছে, সে বিষয়ে পাকিস্তানিদের মাথাব্যথা নেই। তাদের অন্য কোনো দেশের সমর্থনেরও প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, পাকিস্তান অর্থনৈতিক দিক থেকে দেউলিয়া হওয়ার পথে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিধ্বংসী প্রভাবে দেশটি খারাপ অবস্থায় রয়েছে। বন্যায় রাস্তা, সেতু ও অন্যান্য অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তা নির্মাণে পাকিস্তানের বিপুল পরিমাণ অর্থ দরকার। বন্যার পাশাপাশি পাকিস্তানের মুদ্রার দরপতনে আমদানি, ধার ও ঋণ পরিষেবার খরচ বেড়ে গেছে এবং মুদ্রাস্টম্ফীতি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা ইতোমধ্যে কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। বন্যার প্রভাব পড়েছে দেশটির প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষের ওপর। বন্যার পর শত শত কোটি ডলার ঋণের খোঁজে রয়েছে দেশটি। তা ছাড়া পাকিস্তানের অনুৎপাদনশীল অর্থনীতি সংকটকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। ফলে বিদেশি সাহায্য ছাড়া পাকিস্তানের টিকে থাকা কঠিন। সে জন্য আমরা দেখছি, তারা চীনের সহায়তা চাইছে। ইমরান খানের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা শাহবাজ শরিফ এ সপ্তাহেই চীনের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এটা বলা দরকার, পাকিস্তান ১০০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণের ৩০ শতাংশই নিয়েছে চীন থেকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ পাকিস্তানকে শুধু ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে রেখেছে, যাতে দেশটি খেলাপি না হয়ে যায়।

চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে শাহবাজ শরিফকে পাকিস্তানে কর্মরত চীনের নাগরিকদের নিরাপত্তা বিষয়ে স্বাভাবিকভাবেই দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অপ্রত্যাশিত কিছু কড়া কথা হজম করতে হয়েছে। কারণ এ বছরের মধ্যেই করাচিতে আত্মঘাতী এক বোমা হামলায় তিন চীনা শিক্ষক নিহত হন। শি জিনপিং সতর্ক করে বলেছেন, পাকিস্তানে কর্মরত চীনা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের জন্য নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ পরিবেশের প্রত্যাশা করে চীন।

কিন্তু ইমরান খানের ওপর হামলার ঘটনা সেই নির্ভরযোগ্য ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে প্রশ্ন তৈরি করবে, তা বলাই বাহুল্য। সুতরাং, চীন কীভাবে শাহবাজ শরিফের কথায় আশ্বস্ত হবে? পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে বিভাজন এবং এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর যে সমীকরণ- সব মিলিয়ে ইমরান খানের ভবিষ্যৎ কী, সময়ই তা বলে দেবে।

মিহির শর্মা: দিল্লির অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো; ব্লুমবার্গ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক