- মতামত
- সাধুবাদযোগ্য
সাধুবাদযোগ্য
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বিদ্যমান সাক্ষ্য আইনের যে দুইটা সংশোধনী পাস হইয়াছে, তাহা বাংলাদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখিবে বলিয়া আমরা মনে করি। শুক্রবার সমকালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে 'এভিডেন্স অ্যাক্ট ১৮৭২ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল-২০২২' কণ্ঠভোটে পাস হইয়াছে; যেখানে বলা হইয়াছে, আদালতের অনুমতি ব্যতিরেকে জেরার সময় ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার শিকার কোনো নারীকে তাহার চরিত্র ও অতীত যৌনাচরণ লইয়া কোনো প্রশ্ন করা যাইবে না এবং বিচারকাজে বিভিন্ন ডিজিটাল তথ্যকেও সাক্ষ্য হিসাবে উপস্থাপন করা যাইবে। সাক্ষ্য আইন হইতে ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা মামলায় জেরার সময় ভুক্তভোগীকে তাহার চরিত্র ও অতীত যৌনাচরণ লইয়া প্রশ্ন করার সুযোগসংবলিত বিতর্কিত বিধানটি বাতিল করিবার দাবি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং দেশের সচেতন নাগরিকগণ বহু দশক ধরিয়া জানাইতেছিলেন। আর বর্তমান বিশ্বে প্রায় সকল কিছুই যেখানে ডিজিটাল, সেখানে বিচার ব্যবস্থায় উহার উপযুক্ত ব্যবহার না করিবার যথার্থ কোনো যুক্তি থাকিতে পারে না। ফলে জাতীয় সংসদে যেমন বিলটির উপর আলোচনা করিতে গিয়া সরকারি দল ও বিরোধী দলভুক্ত সকল সংসদ সদস্য সংশোধনীসমূহকে স্বাগত জানাইয়াছেন, তদ্রূপ আমরাও তাহাদের স্বাগত জানাই।
ইহা সকলেই অবগত, মূল সাক্ষ্য আইনটি প্রণীত হইয়াছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে, যখন আক্ষরিক অর্থেই দখলদার রাষ্ট্রের অধিবাসী বিবেচিত হইতেন প্রথম শ্রেণির নাগরিক হিসেবে; আর স্থানীয় অধিবাসীরা ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণির পর্যায়ে। তৎকালে স্থানীয় নারীদের উপর বিশেষ করিয়া শ্বেতাঙ্গ পুরুষনিচয় কতভাবে অত্যাচার চালাইত, তাহা কাহারও অবিদিত নহে। ফলে স্বজাতিভুক্ত ধর্ষকদের রক্ষা করিবার নিমিত্তে এমন একটা আইন তাহাদের প্রয়োজন ছিল, যাহার মাধ্যমে ধর্ষিত নারীকে প্রথমেই মিথ্যাভাবে হইলেও চরিত্রহীনা প্রমাণ করিয়া মামলাটিকে লঘু করিয়া দেওয়া যায়। পাকিস্তানি প্রায়-ঔপনিবেশিক আমল উহার অপেক্ষা খুব ভিন্ন ছিল না। অতএব চরম নারীবিদ্বেষী আইনটি বাতিলে ঐ শাসকদের তাগিদ অনুভব করিবার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু দুঃখজনক হইল, স্বাধীন বাংলাদেশেও অন্তত ৫১ বৎসর ধরিয়া নারীর বিরুদ্ধে চরম বৈষম্যমূলক আইনটি বহাল ছিল, যদিও সংবিধানে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ বা জন্মস্থানভেদে কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা যাইবে না বলিয়া পরিস্কারভাবে বর্ণিত। ইহারই সুযোগ লইয়া পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারীরা প্রায় বাধাহীনভাবে নারীর উপর পাশবিক নির্যাতন চালাইয়া গিয়াছে। বাধাহীন কথাটা বলার কারণ হইল, এমনিতেই সামাজিক নানা কালিমার ভয়ে ধর্ষণের শিকার বহু নারী এবং তাঁহাদের স্বজন-শুভাকাঙ্ক্ষী ঘটনাটি জানাজানি হউক এবং তাহা লইয়া কানাকানি হউক; চাহেন না। আর যাঁহারা একটু সাহস সঞ্চয় করিয়া আদালতের দ্বারস্থ হন তাঁহাদের; ইতোপূর্বে প্রকাশিত বিভিন্ন সমীক্ষা অনুসারে, খুব সামান্য অংশই ন্যায়বিচার পাইয়া থাকে। বলা বাহুল্য, এই বিচারহীনতার জন্য যে সকল কারণকে দায়ী করা হইয়া থাকে, উহাদের মধ্যে অন্যতম হইল সাক্ষ্য আইনের ঐ বিতর্কিত ধারা। ধর্ষিতা বা ধর্ষণচেষ্টার শিকার নারীকে সন্দেহের চোখে দেখিবার বিষয়টি সমাজের কতটা গভীরে প্রোথিত, উহার প্রমাণস্বরূপ আমরা গত বৎসর এক ধর্ষণ মামলার শুনানির সময় ঢাকার এক নারী বিচারকের দেওয়া বিতর্কিত নির্দেশনাটি স্মরণ করিতে পারি, যেখানে ঘটনা ঘটিবার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে থানায় না আসিলে ধর্ষণ মামলা নথিভুক্ত না করিবার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
ইহা অনস্বীকার্য, সাক্ষ্য আইনের নারীবিরোধী ধারা বতিল হইয়াছে বলিয়া ধর্ষণের শিকার নারীগণ এখন হইতে ন্যায়বিচার পাইতে শুরু করিবেন- এহেন আশাবাদ যথার্থ নহে। উক্ত আইন ব্যবহারে আমাদের বিচার ব্যবস্থার সহিত যুক্ত এবং মামলা গ্রহণ ও পরিচালনাকারীগণ যথেষ্ট সচেতন না হইলে ইহার সুফলপ্রাপ্তি সুদূরপরাহত হইতে পারে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হইল, আমাদের আইন ও বিচার ব্যবস্থার সহিত সংশ্নিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানকে কয়েক সহস্র বৎসর ধরিয়া বিরাজমান পুরুষতন্ত্রের প্রভাব হইতে মুক্ত করিতে হইবে। ইহা রাতারাতি অর্জন সম্ভব না হইলেও এই লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচারাভিযানসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড চালাইয়া যাইতে হইবে। সাক্ষ্য হিসাবে ডিজিটাল তথ্য ব্যবহার বিষয়েও সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। বর্তমানে বিশেষ করিয়া ডিজিটাল দুনিয়ায় নকলের ছড়াছড়ি সম্পর্কে আমরা সকলেই কম-বেশি অবগত। অধিকন্তু এতদ্রূপ সাক্ষ্য ব্যবহার করিতে যাইয়া সংশ্নিষ্ট সকলের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করাও গুরুত্বপূর্ণ।
বিষয় : সাধুবাদযোগ্য সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন