
ফারওয়াহ মান্নান মোহাম্মদী
ফেসবুক যেন ছেয়ে গেছে শোকে। বুয়েটের অধ্যাপক ও বিজ্ঞান লেখক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী ও ফারহানা মান্নান দম্পতির শিশুকন্যা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মারা গেছে। নাম ফারওয়াহ মান্নান মোহাম্মদী, বয়স মাত্র ৫। মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজন ডাকতেন 'মধু' বলে। পিঠাপিঠি বড় বোন ফেলিসিয়া মান্নান মোহাম্মদী, ডাক নাম 'চিনি'। মৃত্যু কী- বিষয়টি ভালোভাবে বোঝার আগেই ছোট্ট চিনিকে একা করে দিয়ে চলে গেল আরও ছোট্ট মধু। কী হৃদয়বিদারক!
ফারহানা-ফারসীম দম্পতি ফেসবুকে বেশ সক্রিয়। সেই সূত্রে দুই বোনের বেড়ে ওঠার সাক্ষী মাতা-পিতার পেশা ও ব্যক্তিগত বন্ধুরা ছাড়াও সমাজিক মাধ্যম সম্প্রদায়। তাঁদের অনেকের সঙ্গে দুই কন্যারও বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।
মধুর মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ সেই সামাজিক চক্রের কাছেও বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়ে এসেছে। ছোট্ট শিশুটি ঘিরে অনেকের ছোট ছোট আনন্দদায়ক মুহূর্ত, ছবি, কথা নিউজফিডে ভেসে উঠছিল ক্ষণে ক্ষণে। অনেক পোস্টই অজান্তে চোখ ভিজিয়ে দেয়। ফারসীম ভাইকে আমিও চিনি সামাজিক মাধ্যমসূত্রেই। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও উপলক্ষে দ'একবার দেখা ও কুশল বিনিময় হয়েছে। কিন্তু তিনি ও তাঁর সুখি পরিবারটিকে চিনি মূলত ফেসবুক পোস্ট দেখেই। রোববার বিকেলে শোক-বিহ্বল পিতার ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে নিজেও প্রথমে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি লিখেছিলেন- 'আমাদের ছোট মধু আকাশে উড়াল দিয়েছে। কোনো দোয়া শুভকামনা চিকিৎসা আর তাকে ধরে রাখতে পারেনি'। সহজ-সরল ছোট্ট দুটি বাক্য; কিন্তু সজোরে ধাক্কা দিয়েছিল। পিতামাত্রই জানেন, সন্তানের সামান্য অসুখেও কতটা অসহায় লাগে! আর সেখানে এমন অকাল ও অকস্মাৎ মৃত্যু!
ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন- সপ্তাহখানেক আগে সামান্য জ্বরে আক্রান্ত হয় মধু। চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা দেন, সেখানে কিছু ইনফেকশন ধরা পড়লেও ডেঙ্গু নেগেটিভ ছিল। ওষুধ খাওয়ানো হলেও জ্বর না কমায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে আইসিইউতে নেওয়া হলে ডেঙ্গু পজিটিভ হয়। লিভারেও সমস্যা ধরা পড়ে। দুই দিনের মাথায় পরিবার ও চিকিৎসকের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে মৃত্যু। (দৈনিক বাংলা, ৮ নভেম্বর, ২০২২)।
গণযোগাযোগ শাস্ত্রে 'প্যারাসোশ্যাল রিলেশন' বলে একটি ধারণা রয়েছে। এর অর্থ, পরিচয় ছাড়াও দূর থেকে দেখে দেখেই যে হৃদ্য গড়ে ওঠে। ফারসীম ভাইয়ের ফেসবুক দেখে দেখে কোনোদিন কথাবার্তা, সাক্ষাৎ ছাড়াও তাঁর ছোট্ট মেয়েটির সঙ্গে সেই হৃদ্য গড়ে উঠেছিল আমার মতো অনেকের। প্রাণবন্ত সেই শিশুটি এখন কেবলই স্মৃতি; বেদনাদায়ক স্মৃতি।
ফারসীম-ফারহানা দম্পতি যে কোনো বিবেচনাতেই সমাজের অগ্রসর অংশ। তাঁদের সন্তানই যখন ডেঙ্গুর কাছে এমন অসহায়, তখন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের কী পরিস্থিতি? খেটে খাওয়া পরিবারগুলোর সন্তানরা হয়তো এভাবে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের পাদপ্রদীপে স্থান পায় না। কিন্তু শোকের দহন তো তাদেরও বিন্দুমাত্র কম নয়! নেহাত ব্যক্তিগত বেদনা নয়; সামষ্টিক ব্যর্থতাও যেন মধুর জন্য শোক গাঢ়তর করে তোলে।
ডেঙ্গু নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সভা-সমিতিতে প্রতিবছর কত বাগাড়ম্বর করি আমরা! অথচ দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কেবল মৃত্যু সংবাদই পেতে হচ্ছে। আকাশে স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছি, অথচ সামান্য ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না! এই লেখা যেদিন লিখছি, তার আগের ২৪ ঘণ্টাতেও ৮২০ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতদের মধ্যে কমবেশি ১৬ শতাংশের বয়স ১০ বছরের নিচে। ছোট ছোট এসব প্রাণ কত বড় ব্যথা নিয়ে যে চলে যাচ্ছে!
কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন এডওয়ার্ড এম. কেনেডি জুনিয়র। তাঁর চাচা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি বলেছিলেন- আমরা যে সময়ে থাকব না, সেই সময়ের উদ্দেশে পাঠানো জীবন্ত বার্তা হচ্ছে শিশু। সেই শিশুদের আমাদের আগেই চলে যেতে প্রাকারান্তরে বাধ্য করে সমাজ ও রাষ্ট্র আসলে কী বার্তা দিতে চায়?
শেখ রোকন :সম্পাদকীয় বিভাগ প্রধান, সমকাল
skrokon@gmail.com
মন্তব্য করুন