ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্রুত বেড়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের মতে, ২০২১ সালে প্রতি ৮ জনের ১ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ ৬০ বছর বয়সের আগেই ডায়াবেটিসজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। প্রতি ২ জনের ১ জন মানুষ জানেন না, তাঁর ডায়াবেটিস আছে। ৯০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে বাস করছেন। শুধু তাই নয়; এখন অল্প বয়সে আক্রান্ত হওয়ার হারও বাড়ছে। উপার্জনক্ষম একটা বড় জনগোষ্ঠী এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফলে পরিবার, সমাজ বা জাতির ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে। কারণ ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি করে। যেমন হৃদরোগ, কিডনির সমস্যা, অন্ধত্ব, পঙ্গুত্ব ইত্যাদি। তা ছাড়া ডায়াবেটিসের সঙ্গে মানুষ অন্যান্য অসংক্রামক রোগ যেমন উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে চর্বির আধিক্য ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত। দুঃখজনকভাবে অধিকাংশ মানুষ এ রোগ সম্পর্কে সচেতন নন এবং অধিকাংশ মানুষের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকে বিধায় ডায়াবেটিসজনিত জটিলতায় ভোগেন। তাই ডায়াবেটিসের শিক্ষা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর উচিত এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা। শুধু তাই নয়। একজন সেবাদানকারীর দায়িত্ব এ রোগ নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ বুঝিয়ে দেওয়া। ডায়াবেটিস রোগ হয় যখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি থাকে। ইনসুলিন নামক হরমোনের স্বল্পতা বা অকার্যকারিতার কারণে শরীর তার প্রয়োজনীয় শক্তির জন্য যথাযথভাবে গ্লুকোজ ব্যবহার করতে পারে না। মনে রাখতে হবে, ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণযোগ্য, একই সঙ্গে অনিরাময়যোগ্য রোগ। নিজে জানা এবং অন্যকে জানানোর মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ডায়াবেটিসের ধরন, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন সম্পর্কে জানা, সঠিক ওষুধ সেবন, সঠিক নিয়মে ইনসুলিন নেওয়া, নিয়মিত রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ডায়াবেটিসের মাত্রা জানা, পায়ের বিশেষ যত্ন নেওয়া, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, বাড়তি ওজন কমিয়ে ফেলা, পর্যাপ্ত ঘুম এবং বছরে ২-৩ বার চোখ, কিডনি, দেহের চর্বির মাত্রা জেনে নেওয়া খুবই জরুরি, যাতে জটিলতাগুলো আগাম জানা যায় এবং প্রতিরোধ করা যায়। তা ছাড়া প্রজননক্ষম নারীরা সন্তান ধারণের আগেই সঠিক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করে পরিকল্পনামাফিক সন্তান নিলে গর্ভকালীন জটিলতাও এড়ানো সম্ভব।

অধিকাংশ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার পর মেনে নিতে চান না, তাঁর ডায়াবেটিস হয়েছে এবং এর সেবা বা চিকিৎসা নিতে বিলম্ব করেন। অনেকেই প্রথমে ওষুধ সেবন করলেও, ডায়াবেটিস একটু নিয়ন্ত্রণে এলে ওষুধ বন্ধ করে দেন। সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং ব্যায়ামও কোনো কোনো সময় পরিহার করেন। পরবর্তী সময়ে তাঁরা ডায়াবেটিসজনিত বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে আসেন, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনিরাময়যোগ্য। এ ধরনের সেবা বা চিকিৎসার প্রতি অনীহার কারণ অজ্ঞতা। ডায়াবেটিসের সঠিক শিক্ষা এ রোগ নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি। একজন মানুষ নিজে কীভাবে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখবেন, সে বিষয়ে বিশেষভাবে জেনে নেওয়া জরুরি। বিশেষ করে তাঁর শরীরের চাহিদা অনুযায়ী সঠিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা, ব্যায়াম, ওষুধ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা, তা পরিমাপ করে জেনে নেওয়া। রোগী নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এ থেকে সৃষ্ট জটিলতা প্রতিরোধ করা যায়। শুধু তাই নয়, তাৎক্ষণিক জটিলতার কীভাবে চিকিৎসা নিতে হয়- যেমন রক্তের গ্লুকোজ হঠাৎ কমে গেলে কী চিকিৎসা নেবেন সেটা জানা থাকলে অপ্রত্যাশিত জটিলতা যেমন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক বা মৃত্যুও ঠেকানো সম্ভব। তাই ডায়াবেটিস প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে সঠিকভাবে ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানাকে গুরুত্ব দিয়ে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- 'এডুকেশন টু প্রোটেক্ট টুমরো।'

ডা. মারুফা মোস্তারী: সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়