বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ২০১৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯৫ সালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই মেডিসিন অনুষদের ডিন ও মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে সেখানে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। চিকিৎসাক্ষেত্রে অবদানের জন্য ২০১৬ সালে একুশে পদক,  ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমি ফেলোশিপসহ ১২টি সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। এ বি এম আব্দুল্লাহর জন্ম ১৯৫৪ সালে, জামালপুরে।

সমকাল: এবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় রেকর্ড ভেঙে যাওয়ার কারণ কী?

এ বি এম আব্দুল্লাহ: হ্যাঁ, এবার আক্রান্ত ও মৃত্যু নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করছে। কিন্তু এর কারণ এখনও আমাদের অজানা। লক্ষণ দেখে বোঝা যাচ্ছে না, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত কিনা। সামান্য জ্বর, দুই-তিন দিন পর হঠাৎ শরীরে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যাচ্ছে। শরীর ও মাথাব্যথা, রুচিহীনতার পর কোনো কোনো রোগীর হঠাৎ অবস্থার অবনতি হচ্ছে।

সমকাল: এবার বেশিসংখ্যক নারী ও শিশু আক্রান্ত হচ্ছেন।

এ বি এম আব্দুল্লাহ: সব বয়সের নারী-পুরুষই আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে শিশুদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় তারা সহজেই কাবু হয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ নারী যেহেতু বেশিরভাগ সময় ঘরে থাকেন, তাই মশার কামড় খাওয়ার আশঙ্কা পুরুষের তুলনায় তাদের বেশি।

সমকাল: এ ভয়াবহতা আর কতদিন চলতে পারে?

এ বি এম আব্দুল্লাহ: আমাদের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবতার সঙ্গে মিলছে না। সাধারণত এপ্রিল, মে থেকে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকার কথা। কিন্তু এবার নভেম্বরে এসেও যেভাবে আক্রান্ত ও মৃত্যু হচ্ছে, তাতে আমরা চিন্তিত। প্রকৃতি ও আবহাওয়ার তারতম্যের কারণেই এটা হচ্ছে। বর্তমান জলবায়ু এডিস মশার বংশবিস্তারের অনুকূলে। অল্প বৃষ্টিতে জমা পানি এডিস মশার বংশবিস্তারে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। যদি মুষলধারে বৃষ্টি হতো তাহলে এটি বংশবিস্তার করতে পারত না। আশা করি, সামনে কড়া শীত পড়লে এর প্রকোপ কমে যাবে।

সমকাল: ডেঙ্গুর স্থায়ী সমাধান কী?

এ বি এম আব্দুল্লাহ: ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস হচ্ছে গৃহপালিত মশা। এটি দালানকোঠায় থাকতে ও বংশবিস্তার করতে পছন্দ করে। তাই যত নগরায়ণ হবে, তত বেশি ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়বে। শুধু আমাদের দেশে নয়; সিঙ্গাপুর- থাইল্যান্ডেও নগরায়ণের ফলে একই অবস্থা হয়েছে। কোথাও পানি জমে যেন এডিস মশা বংশবিস্তার করতে না পারে, সে জন্য প্রজনন স্থান ধ্বংস করতে হবে। এর পাশাপাশি উড়ন্ত মশাও নিধন করতে হবে। ডেঙ্গুর প্রকোপ কিন্তু এখন আর ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ নেই; মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ মফস্বলেও দালানকোঠা তৈরি হচ্ছে। গণপরিবহনের মাধ্যমে এটি শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়েছে।

সমকাল: স্থানীয় সরকারমন্ত্রী দাবি করেছেন, বিদেশ থেকে এডিস মশা বিমানযোগে আমাদের দেশে এসেছে।

এ বি এম আব্দুল্লাহ: মন্ত্রীর মন্তব্যটি হয়তো রসিকতা ছিল। এ কথা ঠিক, বিমানে তো মশা আসা-যাওয়া করে। তবে এডিস মশা ১৭০০ সাল থেকেই এ দেশে ছিল। আফ্রিকার জঙ্গল থেকে জাহাজের মাধ্যমে এটি ছড়িয়েছে। ২০০০ সালের আগেও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যু হতো। কিন্তু এখনকার মতো সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি আসত না। এখন ডেঙ্গুসহ অন্য রোগ নিয়ে ব্যাপক কাজ হচ্ছে। এ কারণেও বিষয়টি প্রচার বেশি পাচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানেরও অগ্রগতি হয়েছে। বেশিরভাগ রোগীই সুস্থ হচ্ছেন। আগে মৃত্যুর কারণ অজানাই থেকে যেত।

সমকাল: দিনে ও রাতে এডিস মশার কামড়ানো নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে।

এ বি এম আব্দুল্লাহ: একসময় বলা হতো, এডিস মশা সাধারণত দিনে কামড়ায়; রাতে না। এখন প্রমাণ হয়েছে- এটি দিন-রাত নির্বিশেষে কামড়ায়। তবে মিটিমিটি আলোতে বেশি কামড়ায়। অর্থাৎ সকালের দিকে ও সন্ধ্যার আগে ঝুঁকি বেশি। রোদ তীব্র হলে, তাপমাত্রা বাড়লে এটি সাধারণত কামড়ায় না। তাই দিন-রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি টানাতে হবে। শিক্ষার্থীরা মশা থেকে সুরক্ষায় ফুল প্যান্ট, ফুল হাতা জামা পরতে পারে; মশানাশক ক্রিম ব্যবহার করতে পারে।

সমকাল: আক্রান্তদের ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?

এ বি এম আব্দুল্লাহ: এখন চলছে ডেঙ্গুর মৌসুম। তাই অবহেলা না করে উপসর্গ দেখা দিলে শুরুতেই পরীক্ষা করাতে হবে। অস্বাভাবিক জ্বরের পাশাপাশি শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, শরীরের যে কোনো স্থান থেকে রক্তক্ষরণসহ ডেঙ্গুর অন্যান্য লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট তারিখের আগেই ঋতুস্রাব শুরু হলে কিংবা ঋতুস্রাব নির্দিষ্ট সময়ে শেষ না হওয়াও ডেঙ্গুর উপসর্গ। ডেঙ্গু পজিটিভ হলেও ভয়ের কারণ নেই। কারণ ৮০-৯০ শতাংশ রোগী ঘরে বসেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে যান। পানিসহ পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল খেতে হবে। চার থেকে ছয় দিন এ জীবাণু মানবদেহে থাকে। তাই এই সময়ে মশারি টানিয়ে থাকতে হবে। কারণ, আক্রান্ত রোগীকে কামড়ানো মশা সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তিও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবেন।

সমকাল: রাজধানীর বাইরেও কি ডেঙ্গুর মানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে?

এ বি এম আব্দুল্লাহ: ঢাকার বাইরে অনেক মেডিকেল কলেজ ও জেলা সদর হাসপাতাল এ ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া কোনো কোনো বেসরকারি হাসপাতাল ভালো চিকিৎসা দিচ্ছে। অনেক স্থানে রক্ত থেকে প্লাটিলেট প্রক্রিয়াজাতকরণের সুযোগ নেই। এটি কারিগরি দুর্বলতা। শুধু ডেঙ্গু নয়, অন্যান্য রোগেও প্লাটিলেট দরকার হয়। অন্তত জেলা সদর হাসপাতালে এ ব্যবস্থাটি থাকা উচিত। আশা করি, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা কাটিয়ে তাড়াতাড়ি প্লাটিলেট প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্র জেলা সদর হাসপাতালে নিশ্চিত করা হবে।

সমকাল: ডেঙ্গু জ্বরে প্লাটিলেট কমে যাওয়াই তো সবচেয়ে বড় ইস্যু।

এবিএম আব্দুল্লাহ: দেখুন, ডেঙ্গু জ্বর হলেই প্লাটিলেটের পেছনে ছোটার দরকার নেই। অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে প্লাটিলেটের দরকার হয় না। নাক-মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণের মতো জটিল উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকই প্লাটিলেট দেওয়ার পরামর্শ দেবেন। ডেঙ্গু জ্বর হলে প্রথম চার-পাঁচ দিন প্লাটিলেট কমতে থাকে। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। ছয়-সাত দিন পর নিজে নিজেই প্লাটিলেট বেড়ে যায়। ৮-১০ দিনের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।

সমকাল: ডেঙ্গুর চিকিৎসা কতটা ব্যয়বহুল?

এ বি এম আব্দুল্লাহ: মোটেও ব্যয়বহুল নয়। বেশিরভাগ রোগী ঘরে থেকেই সুস্থ হয়ে যান। ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগ হওয়ায় অ্যান্টিবায়োটিক দরকার নেই। তবে অন্য কোনো জীবাণুতে আক্রান্ত হলে চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করলে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন। ডেঙ্গু হলে সাধারণত প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়; অন্য কোনো ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া যাবে না। নিজেরা দোকান থেকে কিনেও খাওয়া যাবে না। এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ে। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গুর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই।

সমকাল: আক্রান্তরা কখন হাসপাতালে ভর্তি হবেন?

এ বি এম আব্দুল্লাহ: বেশিরভাগ রোগী চিকিৎসকের পরামর্শমতো চললে বাসায় থেকেই সুস্থ হয়ে যাওয়ার কথা। যদি রোগীর মধ্যে তীব্র উপসর্গ দেখা দেয় যেমন বমি, পাতলা পায়খানা, রক্তক্ষরণ; তাহলে কালবিলম্ব না করে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। তা ছাড়া আগে থেকেই ক্যান্সার, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি, লিভারসহ জটিল রোগে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে ঘরে বসে ঝুঁকি না নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই শ্রেয়। অন্তঃসত্ত্বা ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে তাঁর ঝুঁকি এড়াতে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়া উচিত।

সমকাল: ডেঙ্গু ও করোনা একই সঙ্গে হলে কোনটির চিকিৎসা আগে হবে?

এ বি এম আব্দুল্লাহ: চিকিৎসক হিসেবে এ রকম রোগী আমিও পেয়েছি। করোনায় আক্রান্ত হলে রক্তে প্লাটিলেট কমে না। ডেঙ্গু জ্বরে প্লাটিলেট কমে যায়। দুটির চিকিৎসাও আলাদা। তাই একটির ওষুধ দিলে আরেকটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। যেহেতু দুটিরই চিকিৎসা ও সুস্থতা দরকার। তাই এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেবেন, কীভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

সমকাল: এডিস নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বে অবহেলা দেখছেন?

এ বি এম আব্দুল্লাহ: সারাবছর খোঁজখবর নেই। অথচ ডেঙ্গুর মৌসুম এলেই তোড়জোড় শুরু হয়। মৌসুমি তৎপরতা নয়; বছরজুড়ে সক্রিয়তা জরুরি। শুধু সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। পাড়া-মহল্লায় সব পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে এডিস মশার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। বাসাবাড়ি নিয়মিত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এডিস মশার লার্ভা যেন না থাকে, নিতে হবে সে পদক্ষেপও। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম।

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

এ বি এম আব্দুল্লাহ: সমকালের জন্য শুভকামনা।