- মতামত
- প্রশ্নটা জবাবদিহির
প্রশ্নটা জবাবদিহির
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষায় সরকার যখন আমদানি কমাইয়া জনসাধারণকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধনে প্রায় বাধ্য করিতেছে এবং বহুবিধ কঠিন শর্তেও আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলির দ্বারস্থ হইতেছে, সেই সময়েই যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্টদের পশ্চাতে প্রতি মাসে শত-সহস্র ডলার ব্যয় হইবার খবর হতাশাজনক বটে। রবিবার সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনসূত্রে জানা যাইতেছে, চলতি বৎসরের শুরুতে লবিস্ট প্রতিষ্ঠান নেলসন মুলিনস রিলে অ্যান্ড স্কারবোরো এলএলপিকে এক বৎসরের জন্য মাসিক কমপক্ষে ২০ সহস্র ডলারের বিনিময়ে নিয়োগ করিয়াছে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মার্চ মাসেই আবার এক বৎসরের জন্য নিয়োগ প্রদান করা হয় আরেক লবিস্ট প্রতিষ্ঠান বিজিআর পাবলিক রিলেশনকে মাসিক ২৫ সহস্র ডলারের বিনিময়ে। শুধু উহাই নহে, ঐ মাসে আরও তিনটা মার্কিন লবিস্ট প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটাকে মাসিক ৫ সহস্র ডলার, আরেকটাকে মাসিক ২০ সহস্র ডলার দিতে হইতেছে; যাহাদের নিয়োগের মেয়াদ এক বৎসর। ইহাদের সহিত আরেকটা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ পাইয়াছে তিন বৎসরের জন্য। ইহার পশ্চাতে ব্যয় হইবে বৎসরে ১ লক্ষ ৬২ সহস্র ডলার। যদিও শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতাসীন দলের এক সংসদ সদস্য নিয়োগ করিয়াছেন বলিয়া প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, উহার দায়িত্ব কিন্তু অন্য প্রতিষ্ঠানগুলির ন্যায়ই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ও নীতিনির্ধারক মহলে তৎপরতা চালানো। এই প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠানকে প্রদত্ত বার্ষিক প্রায় পৌনে ২ লক্ষ ডলার যে রাষ্ট্রের কোষাগার হইতেই যাইবে, তাহা বুঝিবার জন্য গবেষক হইতে হয় না।
উল্লেখ্য, প্রথম দুইটা প্রতিষ্ঠানের সহিত সম্পাদিত চুক্তিসমূহে স্বাক্ষর করিয়াছেন যথাক্রমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব ও ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। তৃতীয় ও চতুর্থ প্রতিষ্ঠানকে নেলসন মুলিনস নিয়োগ করিলেও কার্যটা যে সরকারের পক্ষ হইতে তাহারা করিয়াছে, ইহাতে কোনো সন্দেহ নাই। উপরন্তু, যদিও তিনি লবিস্টদের প্রদেয় ডলারের পরিমাণ বাংলাদেশের রিজার্ভের তুলনায় তেমন কোনো অঙ্ক নহে বলিয়া দাবি করিয়াছেন; পররাষ্ট্রমন্ত্রী সমকালের নিকট স্বীকার করিয়াছেন, তাঁহারা যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করিয়াছেন।
আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রের আইনে দেশটার নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করিতে লবিস্ট নিয়োগ কোনো বেআইনি বিষয় নহে। এই কারণেই তথাকার আইন দপ্তরে লবিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলি কখন কোথায় কাহার সহিত কী চুক্তি করিয়াছে, তাহার পরিপূর্ণ তথ্য সংরক্ষিত থাকে। এমনকি আইন দপ্তর ঐ সকল তথ্য জনগণের অবগতির জন্যও উন্মুক্ত করিয়া থাকে, যাহার মাধ্যমে আমরাও প্রয়োজনীয় তথ্য পাইয়া থাকি। আবার বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রটির প্রশাসনকে জাতীয় স্বার্থে পার্শ্বে পাইবার আশায় বিভিন্ন দেশ বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া লবিস্ট নিয়োগ করিয়া থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টা নৈতিকভাবে অনুমোদনযোগ্য নহে। সংবিধানে লিপিবদ্ধ রহিয়াছে- রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। সেই দিক হইতে রাষ্ট্রের প্রতিটা খাতের আয়-ব্যয়ের হিসাব জনসমক্ষে পরিস্কার থাকিবার কথা। কিন্তু লবিস্টদের পশ্চাতে সরকার যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করিতেছে, উহার উৎস ও হিসাব এমনকি জাতীয় সংসদেও অদ্যাবধি উপস্থাপন করা হয় নাই। মোদ্দা কথা, রাষ্ট্রের মালিকগণকে কার্যত অন্ধকারে রাখিয়াই ঐ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হইতেছে। সাংবিধানিকভাবেও উহা গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না।
বলা হইয়াছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ও নীতিনির্ধারক মহলে বাংলাদেশের 'ভাবমূর্তি বৃদ্ধি' করিবার লক্ষ্যে লবিস্ট নিয়োগ করা হইয়াছে। কিন্তু এই রূপ দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে তৎস্থানে কোটি কোটি ডলার ব্যয়ে পরিচালিত দূতাবাসই রহিয়াছে! দূতাবাস-সংশ্নিষ্টরা কি তাহা হইলে বেকার বসিয়া জনগণের করের টাকার শ্রাদ্ধ করিতেছেন? প্রশ্নটা এই জন্য উত্থাপন করা হইল, প্রতিবেদনমতে- কয়েকজন মার্কিন কর্মকর্তার সহিত আমাদের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বৈঠক আয়োজনের জন্যও নাকি লবিস্টদের দ্বারস্থ হইতে হইয়াছে! আমরা মনে করি, বৈদেশিক মুদ্রার এই ঘোর সংকটকালে দূতাবাস থাকিবার পরেও লবিস্টদের পশ্চাতে কষ্টার্জিত ডলার ব্যয় এক ধরনের বিলাসিতা। অতএব এহেন কার্য পরিত্যাজ্য। অধিকন্তু, জাতীয় কোনো স্বার্থ উদ্ধারের আশায় একান্তই যদি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো লবিস্ট নিয়োগ দিতে হয়, উহা হইতে হইবে চূড়ান্ত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করিয়া।
মন্তব্য করুন