
আমরা মাত্র দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে পা রাখলাম। তখনও সেভাবে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া হয়নি। সবাইকে ধরে ধরে বোঝানোর সুযোগ পাইনি। তাতে প্রথম ম্যাচেই আসে ধাক্কা। যেটা আমাদের মতো দলের সঙ্গে হওয়ায় স্পেনের মানুষ কিছুটা হতাশই হয়ে যায়। কেননা যাত্রাতে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে কুলিয়ে না ওঠা নিয়ে কথা হওয়া যুক্তিযুক্তই ছিল। মিডিয়াও আমাদের সমালোচনায় মুখর হয়, যে কারণে ড্রেসিংরুমে বাজে একটা প্রভাব পড়ে। সবার মন ভেঙে যায়। আমরা ধীরে ধীরে সেটা কাটিয়ে উঠি। এমন হোঁচটের পর আমি চাইলে পরের ম্যাচে সাত-আটজন পরিবর্তন করতে পারতাম। এতে আমার জন্য হয়তো ভালো হতো। লোকে বলত, এটাই ভালো হচ্ছে। কিন্তু আমি সেটা করিনি। পরের ম্যাচে আগের একাদশের সঙ্গে ফার্নান্দো তোরেস ও জেসুস নাভাসকে খেলাই। যার সুফল আমরা পেয়েও যাই।
এক এক করে ম্যাচ জিতে ফাইনালে উন্নীত হই। আমার মন বলছিল, ছেলেরা এবার পারবে। আমার স্বপ্নে সোনালি ট্রফি বারবার আসতে থাকে। আমার রোমাঞ্চ আরও বেড়ে যায়। ফাইনালের আগের দিন সবাইকে ডেকে আমি একটি কথাই বলেছি, এটা যুদ্ধ নয়, ফুটবল। ঢাল-তলোয়ার ছাড়াও একরকম যুদ্ধ। আমাদের পাশে আছে পুরো দেশ, লাখো সমর্থক। তাঁদের নিয়েই আমরা মাঠে নামব। বিশ্বাস রাখো, জয়টা আমাদেরই হবে। আর এই ম্যাচটাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে। আমরা ফুটবলের শিল্পী। এই লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে। তবে হারলেও কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। স্পেন এগিয়ে যাচ্ছে, এই এগিয়ে যাওয়ার পথে আমাদেরও রাখতে হবে অবদান। বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে হবে, এই দলটা কী করতে পারে। আমার কথাগুলো সবাইকে আরও বেশি ফুরফুরে করেছিল। অনেকটা চাপমুক্ত দল অনুভব করি। সবার মুখে নির্ভার এবং আত্মবিশ্বাসের হাসি দেখি।
আমাদের জানা ছিল, সে বছর নেদারল্যান্ডস কতটা দাপট দেখিয়েছে টুর্নামেন্টজুড়ে। সে অনুযায়ী আমাদের প্রস্তুত হতে হবে, সেটাও জানতাম। রোবেনদের মতো তারকাদের কীভাবে আটকাতে হবে, সেই ছকটা করা শুরু করি। শেষ মিনিট পর্যন্ত আমরা সত্য ছিলাম, যেভাবে চেয়েছি, সেভাবেই সবকিছু হলো। এটা সত্য, ভাগ্য আমাদের পাশে ছিল। এই যেমন রোবেনের শটটা পা দিয়ে থামিয়ে দেয় ক্যাসিয়াস। দেখুন, ভাগ্য সঙ্গী না হলে বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায় না।
ফাইনালে যখন ডাচরা একটু আগ্রাসী ভঙ্গিতে খেলা শুরু করেছিল, বিশেষ করে তাদের নাইজেল ডি জং বাজেভাবে আমাদের আলোনসোকে ট্যাকল করেছিল; সে মুহূর্তটা আমাদের জন্য মোটেও স্বস্তির ছিল না। আমরা জানতাম, নেদারল্যান্ডস এমন ফুটবল খেলে না। তারা একটু সুন্দর ধরন মাথায় নিয়ে প্রতিপক্ষকে আটকায়। যেহেতু বিশ্বকাপের ফাইনাল, সবাই চাইবে জিততে। সে ক্ষেত্রে আগ্রাসী কিছু হতে পারে- এমনটা আমি মনে মনে ধরে নিই। পরে অবশ্য তাদের কোচ রিয়াল দর্শনে এলে তাঁকে বলি, কিন্তু তিনি আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক।
নিজে থেকেই বিষয়টি নিয়ে অনুতপ্ত বোধ করেছিলেন। আসলে আমি সেদিনও এতটা চাপে ছিলাম না। এর আগে অনেক ম্যাচ হয়েছে, যেখানে আমার পা ঠিকঠাকভাবে শক্তি দেয়নি, দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছিল। আমি কখনও ভাবিনি, সব সময় আমাকে জিততে হবে। আমি ফুটবলকে উপভোগ করেছি। হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করেছি। আমি সেই কোচ নই, যে ভয়ে থমকে যাব।
বিশ্বকাপ জেতার আনন্দটা স্পেশাল। এটার সঙ্গে আসলে অন্য কোনো অর্জনের তুলনা হয় না। ট্রফিটা জেতার পর আমার ছেলে যখন জানতে চেয়েছিল, আমি কেঁদেই ফেলি। আমি কৃতজ্ঞ মা-বাবার প্রতি, সেই সঙ্গে আমার ভাই। যাঁরা কিনা আমার এই সাফল্যের পেছনের নায়ক ছিলেন।
ট্রফিটা জয়ের পর পুরো স্পেনে খুশির জোয়ার। দেশটির কর্তারা আমাকে নিয়ে নানাভাবে প্রশংসায় মাতেন। আসলে আমি স্রেফ একজন কোচ। এই অর্জনটা তাদের, যারা মাঠে দারুণ ফুটবল খেলেছে। তারাই স্পেনকে প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফিটা এনে দেয়। আমি মনে করি, এটাই ছিল দেশকে সারাবিশ্বের সামনে উপস্থাপন করার সেরা উপায়। এর পর ২০১৪ বিশ্বকাপটা আমাদের জন্য ভালো ছিল না। আসলে ব্যাক টু ব্যাক একই কাজ করা অসম্ভব। তবু আশা ছিল, আরেকটু ভালো করার। সেটা হয়নি! ২০১০-এর পর কিছু খেলোয়াড়কে আমি আর পাইনি। নতুন করে আবার দলটা গড়তে হয়েছিল। কোথায় যেন ঘাটতি অনুভব করি। যেটা ব্রাজিলের মাটিতে দেখা যায়। এর পর তো ২০১৬ সালের ইউরোর পর আমি অবসর নিলাম। কোচিংটা ছাড়তে কষ্ট হয়েছিল। ছাড়ার পর অনেকেই আবার প্রস্তাব পাঠায়। চীন আমাকে কোচ করেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি সবাইকে বলে দিই, আমি এখানেই থামতে চাই। বাকি সময়টা আমার পরিবারের জন্য উৎসর্গ করতে চাই। ফুটবল এখন আর আমার চ্যাপ্টারে নেই।
লেখক :বিশ্বকাপজয়ী সাবেক কোচ
মন্তব্য করুন