- মতামত
- যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার আত্মঘাতী
ইউক্রেন যুদ্ধ
যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার আত্মঘাতী

ধরুন, আপনি ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে বাস করছেন। কিয়েভ এমন শহর, যেখানে ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও অপেক্ষাকৃত শান্ত পরিবেশ বজায় থাকে। শীতের এক সকালে অস্পষ্ট গুঞ্জনে আপনি জেগে ওঠেন। শব্দটি ধীরে ধীরে আরও স্পষ্ট হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত বিকট শব্দে তা যেন আপনার অ্যাপার্টমেন্টের জানালায় আছড়ে পড়ে। আপনি বাইরে উঁকি দিয়ে দেখেন, আপনার প্রতিবেশীর বাড়িতে আগুনে জ্বলছে। বাইরে প্রচণ্ড ধোঁয়া। নিচে ভালো করে তাকিয়ে দেখছেন, কিছু ড্রোন পড়ে আছে। আপনাকে ভার্চুয়াল যুদ্ধের দুনিয়ায় স্বাগত।
গত মাসে কিয়েভে রাশিয়ার এক হামলা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, স্বয়ংক্রিয় ও স্বল্পমূল্যের যুদ্ধাস্ত্র কীভাবে যুদ্ধ আরও ভয়ংকর করে তুলছে। এসব আক্রমণ দেখে মনে হয়, ভবিষ্যতে রোবটিক এমন অস্ত্র ভার্চুয়ালি তাক করে যে কাউকে ধ্বংস করে দিতে পারে। শুধু সামরিক বাহিনী নয়, যে কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন ও দুর্বৃত্ত সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। এমনকি শখের ড্রোনকেও গ্রেনেড কিংবা অন্যান্য বিস্ম্ফোরক ভরে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে তা নিক্ষেপ করা যায়।
রাশিয়ান বাহিনী ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনের ওপর যত হামলা চালিয়েছে, তার অনেকটিতে তারা একই কোম্পানির তৈরি ড্রোন ব্যবহার করেছে। এটা সেই কোম্পানি, যারা কালাশনিকভ রাইফেল তৈরি করে। রাশিয়ার অস্ত্রাগারে সবচেয়ে নতুন অস্ত্র হলো ইরানের তৈরি শাহেদ ১৩৬ ড্রোন। দামের দিক থেকে যেটি একটি টয়োটা করোল্লা গাড়ির সমান। কিয়েভ অভিযানের সময় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ইঞ্জিনের মাধ্যমে এই শাহেদ ড্রোন ব্যবহার করা হয়। এমনকি শাহেদ ১৩৬-এর বিভিন্ন অংশ যে কেউ চাইলে কিনতে পারে এবং তা অনলাইনে অর্ডার করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্যাটেলাইট প্রযুক্তির মাধ্যমে ড্রোন দিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে সহজেই আঘাত হানা যায়। এ ধরনের রোবটিক বোমা
ইউক্রেনের শহরগুলোতে ধ্বংসলীলা বইয়ে দিতে সক্ষম। গত মাসে ইউক্রেন অভিযানে কিয়েভের রাস্তায় ভয়ংকর অবস্থা তৈরি হয়। ড্রোন হামলার সময় পুলিশ সেখানে এলোপাতাড়ি গুলি করে। এ ধরনের ব্যাপক ভীতির মধ্যে বাস করার কারণে সংশ্নিষ্ট এলাকার মানুষের মানসিক সংকট তৈরি হতে পারে।
ইউক্রেন বাহিনীও এরই মধ্যে হামলায় রোবটের ব্যবহার শুরু করেছে। কয়েক দিন আগে ইউক্রেনীয় বায়বীয় ও সমুদ্র ড্রোন সেবাস্টপল-এর ক্রিমিয়া বন্দরে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র জাহাজে হামলা করে এর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহে ইউক্রেনীয় বাহিনী মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে তুরস্কের তৈরি দূর-নিয়ন্ত্রিত ড্রোন রাশিয়ান বাহিনীর বিরুদ্ধে নিক্ষেপ করে। কয়েক মাস ধরে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অনেক 'সুইসাইড ড্রোন' সংগ্রহ করে। এসব ড্রোনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট গন্তব্যকে লক্ষ্য করে সহজেই আক্রমণ চালানো সম্ভব।
এই ভার্চুয়াল যুদ্ধ প্রলুব্ধকর। এর ফলে এমন হতে পারে, কখনও সামরিক বাহিনী ছাড়াই, কোনো শারীরিক যুদ্ধ ছাড়াই, এমনকি হয়তো কোনো মৃত্যুক্ষয় ছাড়াই বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে যুদ্ধ পরিচালিত হবে। তবে এই ভার্চুয়াল যুদ্ধ অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বিধ্বংসী হতে বাধ্য। স্বয়ংক্রিয় যে অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে, তাকে অনেকে 'হত্যাকারী রোবট' বা 'স্লটারবটস' বলে। এর মাধ্যমে কোনো মানুষের ব্যবহার ছাড়াই লক্ষ্যস্থিত মানুষকে শনাক্ত করে হত্যা করা সহজ হবে। এসব প্রযুক্তি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এবং এমন অ্যালগরিদমে সাজানো, যাতে এটি সহজেই লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করে কখন এবং কোথায় হামলা করবে, সে সিদ্ধান্তও নিতে পারে। যদিও আমরা এখনও রোবটিক অস্ত্রের সে পর্যায়ে স্বাভাবিকভাবে পৌঁছিনি; তারপরও আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর অস্ত্রগুলোকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন করার বিপদ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।
সম্পূর্ণভাবে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র মানুষের সিদ্ধান্ত প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নেয়। এটা খুবই ভয়ের ব্যাপার। ২০০১ সালের পেন্টাগন হামলায় প্রথম ব্যবহারের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ দূর-নিয়ন্ত্রিত এ ড্রোন দিয়ে হাজারো বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে। এই পরিসংখ্যানও আমাদের শঙ্কিত না করে পারে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর নিজস্ব নথিতে প্রকাশ হয়েছে, বিমান হামলার বাইরেও কীভাবে ২০১৪ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে এ ড্রোন হামলায় বহু নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
দূর-নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র অধিক বিধ্বংসী হওয়া স্বাভাবিক। কারণ এর কোনো আবেগিক দিক নেই। নির্দয়ভাবে যে কাউকে এরা হত্যা করতে পারে। আহমেদ আলি জাবেরের কথা আমরা জানি, ইয়েমেনে মার্কিন ড্রোন দিয়ে যাঁর স্বজনদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। ভার্চুয়াল এ যুদ্ধ কতটা মনস্তাত্ত্বিক সংকট তৈরি করতে পারে, তা আলি জাবেররাই জানেন। তাঁর ভাষায়, আমি তাদের এ অবস্থায় দেখতে চাইনি। আমি চাইনি, আমার জীবিত থাকা পরিবারের সদস্যরা এখনও ড্রোনের শব্দে কেঁপে উঠুক, যে শব্দ আমাদের কাঁদায়। এটি শত্রুদেরও মানসিকতায় সংকট তৈরি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ড্রোন পাইলট গুরুতর মানসিক চাপ, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাসহ ট্রমায় ভুগছে।
খুব দেরি হওয়ার আগেই ভার্চুয়াল এই যুদ্ধের হুমকি এড়াতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। সরকার ও জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কীভাবে এই স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায়। অন্যথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইরান ও রাশিয়ার মতো বিবদমান পরাশক্তি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন অস্ত্রগুলো নিজেদের মতো ব্যবহার করতে চাইবে। বর্তমান অবস্থাকে শীতল যুদ্ধের প্রথম দিককার পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার সঙ্গে তুলনা করা যায়। এসব যুদ্ধের বিস্তার আমাদের সবার জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে।
'অটোমেটেড ডিসিশন রিসার্চ'-এর মতে, ৭০টির অধিক দেশ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার সীমিতকরণ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে অস্ত্রে রূপান্তর না করার আহ্বান জানিয়ে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির দাবি জানিয়েছে। এই আন্দোলন যখন জোরালো হচ্ছে এবং এর ব্যাপ্তি যখন বাড়ছে; একে একটি সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত, যাতে ডিজিটাল এই যুদ্ধের ব্যাপারে অন্য যারা উদ্বিগ্ন, তাদের প্রত্যাশাও পূরণ হয়। এ ব্যাপারে এখনই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। সময় গেলে সাধন হবে না।
রবার্ট জে. গঞ্জালেজ: চেয়ারম্যান, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, স্যান জোস স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র; কাউন্টারপাঞ্চ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
মন্তব্য করুন