দেশের বহু ব্যাংক বিদেশে উচ্চশিক্ষার্থে গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীদের নামে 'স্টুডেন্ট ফাইল' তথা বিদেশে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের নিকট বৈধ পথে টাকা প্রেরণের প্রক্রিয়া খুলিতেছে না বলিয়া বুধবার সমকালের এক প্রতিবেদনে যাহা বলা হইয়াছে, তাহাতে উদ্বিগ্ন হইবার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। প্রতিবেদন অনুসারে, ব্যাংকগুলি নূতন ফাইল খোলা শুধু স্থগিতই করে নাই; পূর্বে খোলা ফাইলের বিপরীতে অর্থ প্রেরণেও কঠোরতা অবলম্বন করিতেছে। এহেন পরিস্থিতিতে স্বভাবতই বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণেচ্ছু শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন ম্লান হইবার শঙ্কা দেখা দিয়াছে। অধিকন্তু তথায় উচ্চশিক্ষারত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনও হুমকির মুখে পড়িতে পারে।
আমরা জানি, স্টুডেন্ট ফাইলের অধীনে যে কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের সহিত যুক্ত শাখায় বিদেশ গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীর নামে হিসাব খুলিতে হয়। সেই হিসাবে জমাকৃত অর্থ সংশ্নিষ্ট শিক্ষার্থী বিদেশে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইয়া থাকেন উহার কর্তৃপক্ষের নিকট সংশ্নিষ্ট দেশের মুদ্রায় পৌঁছাইয়া যায়। এই বৈধ পথে বিদেশে অধ্যয়নরত সন্তানের নিকট অর্থ প্রেরণ বাধাগ্রস্ত হইলে অভিভাবকদের নিকট বিকল্প অবৈধ হুন্ডি প্রক্রিয়া, যাহার কারণে আমাদের দেশ প্রতি বৎসর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা হইতে বঞ্চিত হইতেছে। সুতরাং স্টুডেন্ট ফাইলে কঠোরতার মাধ্যমে হুন্ডি প্রক্রিয়াকে প্ররোচিত করিবার পক্ষে কোনো যুক্তি থাকিতে পারে না। স্টুডেন্ট ফাইল বিষয়ে বিদ্যমান কঠোরতার কারণ ব্যাখ্যা করিতে গিয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের জনৈক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলিয়াছেন, এই প্রক্রিয়ায় প্রেরিত অর্থ বিদেশে ভিন্ন খাতে ব্যবহূত হইবার শঙ্কা থাকিয়া যায়। কিন্তু এই প্রকার লেনদেনের সহিত যুক্ত অন্তত দুইটা বাংলাদেশি ব্যাংকের বর্তমান ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুস্পষ্টভাবে বলিয়াছেন- যেই রূপ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় তাঁহারা স্টুডেন্ট ফাইলের অর্থ বিদেশে প্রেরণ করিয়া থাকেন, তাহাতে উল্লিখিত অর্থ ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হইবার অবকাশ থাকে না। উপরন্তু এই প্রক্রিয়ায় প্রেরিত সকল বৈদেশিক মুদ্রার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব সরকারের নিকট থাকে। ইহার
ফলে দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভবপর।
ইহা অনস্বীকার্য, বিশ্বের বহু দেশের মতো নানা কারণে বাংলাদেশও বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা তথা ডলার সংকট মোকাবিলা করিতেছে। অনেক প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা যাইতেছে না। এমনকি সরকার ঘোষণা দিয়া সরকারি কর্মকর্তাদের সরকারি অর্থ ব্যবহার করিয়া যে কোনো প্রকার বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করিয়াছে। এমতাবস্থায় মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ করিতে ব্যাংকগুলি স্টুডেন্ট ফাইল খোলা বা পরিচালনায় অতিরিক্ত সচেতনতা দেখাইতেছে। কিন্তু ইহাও স্মর্তব্য, আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ কোনো বিচারেই সেমিনার-সিম্পোজিয়াম বা কর্মশালায় অংশগ্রহণের নামে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণতুল্য হইতে পারে না। ইহা কতিপয় ধনীর সন্তানের উচ্চাভিলাষও নহে। বিদেশে যথার্থ মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা অর্জনের গুরুত্ব এখন বহু মধ্যবিত্ত পরিবারের উপলব্ধিতে আসিয়াছে। তাই সংসারের অনেক প্রয়োজনীয় ব্যয় কাটছাঁট করিয়া ঐ ধরনের অভিভাবক তাঁহাদের সন্তানদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার্থে প্রেরণ করেন। আর বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতীয় সক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি বর্তমান প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে টিকিয়া থাকিবার প্রয়োজনেও বিদেশি শিক্ষার্জনের গুরুত্ব অপরিসীম।
আমরা মনে করি- বিদ্যমান ডলার সংকটের মধ্যেও যেসব বিষয় অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা, তন্মধ্যে বিদেশে উচ্চশিক্ষা অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত থাকিবে। এই প্রসঙ্গে আরেকটা কথাও গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া মনে করি, অদ্য আমাদের যে শিক্ষার্থী বিদেশে অধ্যয়ন করিতেছে, তাহার সমাপনীতে দেশে প্রত্যাবর্তন না করিয়া যদি তথায় কর্মসংস্থানও খুঁজিয়া লয়, তাহা হইলেও জাতি কোনো রূপে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে না। কারণ সে তখন দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণ করিবে। অর্থাৎ দেশ বর্তমানে যে পরিমাণ ডলার তাহার পশ্চাতে ব্যয় করিতেছে, আগামীতে তৎপরিমাণ বা ততোধিক ডলার দেশে আসিবার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। স্টুডেন্ট ফাইল সংক্রান্ত জটিলতায় যদি বিদেশগমনই বিলম্বিত কিংবা বিড়ম্বিত হয়, তাহা হইলে তো সকলই গরল ভেল! অতএব, যাঁহারা ডলার সংকট মোকাবিলার নামে স্টুডেন্ট ফাইল খোলা বা পরিচালনায় বিড়ম্বনা সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীদের বিদেশে অধ্যয়নকে নিরুৎসাহিত করিতেছেন, তাঁহারা অবশ্যই ভ্রান্ত পথে হাঁটিতেছেন। ব্যাংকগুলির নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিংবা সরকারের সংশ্নিষ্ট বিভাগের কর্তব্য হইবে অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের বিদেশে অধ্যয়নের পথ পূর্বের ন্যায় মসৃণ রাখিয়া দেওয়া। অধ্যয়নের পথে অযথা বিড়ম্বনা কাম্য নহে।

বিষয় : সম্পাদকীয় অযথা বিড়ম্বনা

মন্তব্য করুন