সমস্যা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং ব্যক্তিগত থেকে সামাজিক জীবনে আমরা সবাই নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হই। সমস্যা হলে সমাধান করতে হয়, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে নিজের পরিবারের মধ্যকার বিরোধে বাইরের মানুষ অনেক সময় সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে নিজেরা লাভবান হয়। এমনও দেখা যায়, গ্রাম্য বিচারকরা কোনো কোনো সময় সমস্যা সমাধান করার চেয়ে সমস্যা আরও জটিল করে দেন। ফলে কেউ কেউ উভয়ের কাছ থেকে যেমন সুবিধা নেন।

আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা নতুন নয় এবং সে অস্থিরতার ফলে বাইরের হস্তক্ষেপ হয়ে থাকে। এরশাদ সরকারের পতনের পর তথা ১৯৯০ সালের পর থেকে যত সরকারই এসেছে, এ দৃশ্য বারবার দেখা গেছে। সেই দৃশ্য এখন আবার দেখা যাচ্ছে এবং আমরা অনেকেই হয়তো বুঝে কিংবা না বুঝেই বিদেশিদের স্বাগত জানাচ্ছি। সম্প্র্রতি দেশে যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি চলমান আছে, তাতে কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিরা কিছু মন্তব্য করেছেন। তাঁরা দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা করছেন বা আমাদের অনেক রাজনৈতিক দল ও নেতারাও তাদের সঙ্গে দেখা করছেন। তাদের মধ্যে কী আলাপ হয়েছে তা হয়তো জানা যাবে না কিন্তু সেটা যে খুব ইতিবাচক তা আশা করা দুরূহ। 

সম্প্র্রতি জাপানি রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যের পর সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি এ নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন এবং ভিয়েনা সনদের কথা মনে করে দিয়েছেন। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কূটনীতিকরা বিদেশি রাষ্ট্রের বিদ্যমান আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেই চলবেন যদিও অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের দায়মুক্তির সুযোগও আছে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো প্রকার মতপ্রকাশ না করার কথা সে সনদে বলা হয়েছে। 

রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করেন দেশের জন্য। দেশের উন্নয়ন, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দেশের সম্মান ও নিরাপত্তা রক্ষায়ও কাজ করতে হয়। সরকারের কোনো কাজে বিরোধীরা নাখোশ হতেই পারেন কিন্তু এর প্রতিবাদ করার গণতান্ত্রিক মাধ্যম রয়েছে। সংবিধান বলছে, জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস্য অথচ আমরা ধরনা দেই বিদেশিদের কাছে- এটা কেমন আচরণ। 

প্রশ্ন হচ্ছে, সব জানার পরও কেন, বিদেশিদের কাছে বলতে হচ্ছে? এখানে সরকারের দায় ও দায়িত্ব দুটিই আছে। বিরোধী দলের দাবি, অভিযোগ দেখার দায় কিন্তু সরকারের। আবার বিরোধী দল যাতে দেশে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ করতে পারে তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও সরকারের। যদি এখানে কোনো ব্যত্যয় হয় তাহলে তাদের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয় তা কোনো না কোনোভাবে প্রকাশিত হয় এবং বিদেশিদের কাছে অভিযোগ করা এর বহিঃপ্রকাশ বলা যায়। তাহলে বলতে হয়, সরকারের আচরণ এমন হওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয় যাতে বিরোধীরা অসহায় হয়ে ভিনদেশিদের কাছে সাহায্য চাইতে হয়। বিরোধীদের এমন আচরণ কেবল সরকারের জন্য লজ্জার নয়, সরকারের ব্যর্থতাকেও প্রতিফলিত করে। এখানে অন্য একটি বিষয়ও বিবেচ্য। অন্য দেশ কি নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আমাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলবে? পৃথিবীর ভূ-রাজনীতি বলে প্রত্যেক দেশই নিজেদের স্বার্থ ছাড়া অন্যদের বিষয়ে মাথা ঘামায় না। তাহলে বিদেশি কোনো রাষ্ট্র বা তাদের প্রতিনিধি যখন আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলে তখন আমাদের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়।

আমাদের রাজনীতিবিদরা কথায় কথায় জনগণের কথা বলেন, কিন্তু বিদেশিদের কাছে অভিযোগ করার আগে কী সেই জনগণের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না? ১৯৪৭ সালে দেশভাগের মাধ্যমে আমরা ব্রিটিশদের অধীন থেকে মুক্ত হয়েছি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছি কিন্তু মানসিকভাবে আমরা কি স্বাধীন হতে পেরেছি? যদি হতাম তাহলে হয়তো ১৯৯০ সালের পর থেকে আমরা এভাবে বিদেশিদের কথা বলার সুযোগ তৈরি করে দিতাম না। আমরা কেবল বিদেশিদের অভিযুক্ত করছি কিন্তু নিজেদের ব্যর্থতা আলোচনা করি না। কেন বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান সে আলোচনাও করা দরকার। আমাদের রাজনীতিবিদদের মানসিক দৈন্য বারবার জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জা দিচ্ছে এ ভাবনা থাকা দরকার। 

এ কথা সত্য যে, আমাদের এখনও অনেক দাতা দেশের সহযোগিতায় চলতে হচ্ছে। তাই তাদের অনেক পরামর্শ আমাদের মেনে চলতে হয়। কিন্তু এর মানে এই না যে, আমাদের নিজেদের কোনো অবস্থান নেই; দাতাদের আমাদের বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ দেব। বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়েছে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। তাই আমাদের নিজেদের নিজে সম্মান দেওয়া দরকার। সমস্যা থাকবেই এবং তা নিজেদের মধ্যেই আলোচনা, প্রতিবাদের মাধ্যমে সমাধান করে নিতে হবে। মনে রাখা দরকার, বিদেশিরা কখনোই আমাদের সমস্যার সঠিক সমাধান করে দিতে পারবে না যদি না আমরা নিজেরা বদলাতে পারি। মানসিকভাবে আমরা দেশটাকে 'গরিবের বউ' ভাবি বলেই অন্যরা আমাদের 'ভাবি' ডেকে সুযোগ নিচ্ছে।

বিষয় : বিদেশিদের কাছে অভিযোগ রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ গরিবের বউ

মন্তব্য করুন