সম্প্রতি সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে বিজিবি-বিএসএফ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের কলকাতায় চার দিনব্যাপী (১৩-১৬ নভেম্বর) অনুষ্ঠিত বিজিবি ও বিএসএফ আঞ্চলিক কমান্ডার পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলনে তারা এই ঐকমত্যে পৌঁছে। পরিহাসের বিষয়, ওই সম্মেলন চলাকালেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশের কৃষক হত্যার ঘটনা ঘটেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ১৩ নভেম্বর ফেনীর বাঁশপদুয়া গ্রামের সীমান্তবর্তী এলাকায় বাংলাদেশের অংশে ধান কাটছিলেন কৃষক মেজবাহ উদ্দিন। এ সময় বিএসএফ ওই সীমান্ত এলাকায় চোরাকারবারিদের ধাওয়া করতে গিয়ে বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে এবং মেজবাহ উদ্দিনকে আটক করে নিয়ে যায়। এ ঘটনার পরদিন পরপর তিনবার বিজিবি ও বিএসএফের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় পতাকা বৈঠক হয়। কিন্তু মেজবাহ উদ্দিনকে ধরে নেওয়ার বিষয়টি বিএসএফ অস্বীকার করে। অবশেষে বাংলাদেশের সীমান্তের মধ্যে ধান কাটতে থাকা কৃষককে বিএসএফ ধরে নেওয়ার তিন দিন পর সীমান্তে তাঁর লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।
সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার ব্যাপারে এ ধরনের আশ্বাস ও আশ্বাসভঙ্গের ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগে বহুবার এ ধরনের কথা বলা হয়েছে। তারপরও বিএসএফ কর্তৃক সীমান্ত হত্যা চালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমনকি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে যেদিন ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ঘোষণায় সীমান্তে প্রাণহানির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনার কথা বলে দুই পক্ষ থেকে সন্তোষ প্রকাশ এবং সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য কাজ করার ব্যাপারে সম্মতির কথা জানানো হয়; ঠিক সেই দিন, ৭ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় বিএসএফ মিনহাজুল ইসলাম নামে এক বাংলাদেশি কিশোরকে গুলি করে হত্যা করে।
২০১৮ সালের এপ্রিলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সম্মেলনে সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার বিষয়ে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবমতে, ২০১৮ সালে হত্যা করা হয় ১৪ জনকে এবং ২০১৯ সালে হত্যা করা হয় তার তিন গুণ- ৪৩ জনকে। আসকের হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০২০- এই ১১ বছরে ৫২২ জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে বা নির্যাতনে মারা গেছেন।
সীমান্ত হত্যার প্রসঙ্গ উঠলেই বিএসএফ 'আত্মরক্ষার জন্য' 'বাধ্য হয়ে' গুলি চালানোর অজুহাত দাঁড় করায়। এ বছরের জুলাই মাসে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সম্মেলন শেষে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএসএফের মহাপরিচালক পঙ্কজ কুমার সিং বিএসএফের গুলিতে নিহত সব বাংলাদেশিকে অপরাধী বলে সাব্যস্ত করেছিলেন; যেন সাক্ষী-সাবুদ, বিচার-আচার ছাড়াই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী চাইলেই ভিনদেশি কোনো নাগরিককে অপরাধী হিসেবে সিল মেরে দিতে পারে। তারপর ওসেই কথিত অপরাধীকে বিনা বিচারে হত্যা করার অধিকার রাখে!
প্রথমত, ভারতের পেনাল কোড কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো আইনেই নিরস্ত্র নাগরিককে গুলি বা নির্যাতন করে মেরে ফেলার বিধান নেই। কেউ অবৈধভাবে সীমান্ত পার হলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে বিচার করা যেতে পারে। ভারতের কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের সেকশন ৪৬ অনুসারে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টার বৈধতা দেওয়া হলেও মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সাজা হওয়ার মতো অপরাধে লিপ্ত না হলে কোনোভাবেই হত্যা করা যাবে না। ১৯৯০ সালে কিউবার হাভানায় জাতিসংঘের অষ্টম কংগ্রেসে গৃহীত বেসিক প্রিন্সিপালস অন দ্য ইউজ অব ফোর্স অ্যান্ড ফায়ার আর্মস বাই ল এনফোর্সমেন্ট অফিশিয়ালস নামের নীতিমালা অনুসারেও আইন প্রয়োগের বেলায় মানুষের জীবন রক্ষার ব্যাপারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। যে কোনো সভ্য রাষ্ট্রেরই উচিত প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আচরণ করা। ভারত যদি বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্রই হয়, তাহলে বন্ধু দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী কী কারণে এভাবে দিনের পর দিন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব ধরনের আইন ভঙ্গ করে সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যা করে চলেছে!
দ্বিতীয়ত, এমনকি বিএসএফের আত্মরক্ষার অজুহাতও গ্রহণযোগ্য নয়। কাঁটাতারে কাপড় আটকে যাওয়া এক নিরস্ত্র কিশোরী ফেলানী কিংবা ক্ষেত থেকে ধান কাটতে থাকা কৃষক মেজবাহ উদ্দিন কী করে অস্ত্রধারী বিএসএফের জন্য হুমকি হতে পারেন! হিউম্যান রাইটস ওয়াচের 'ট্রিগার হ্যাপি' নামের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে বিএসএফ কীভাবে সন্দেহভাজন অপরাধীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা বা সতর্ক না করেই নির্বিচারে গুলি চালায়। দেখা গেছে, অপরাধী হিসেবে সীমান্ত হত্যার শিকার ব্যক্তিরা হয় নিরস্ত্র থাকেন অথবা তাঁদের কাছে বড়জোর কাস্তে, লাঠি বা ছুরি থাকে। এমন ব্যক্তিদের মোকাবিলায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিয়মিত প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। যার জন্য ভারত সরকার তাদের দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দিয়েছে- এমন দৃষ্টান্ত নেই।
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভোরে বিএসএফ কর্তৃক ফেলানী হত্যাকাণ্ডের পর তার লাশ দীর্ঘ সময় ঝুলে ছিল কাঁটাতারের বেড়ায়। কাঁটাতারে ঝুলে থাকা কিশোরী ফেলানীর লাশ প্রবল আলোড়ন তুলেছিল দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে। কিন্তু এ রকম আলোড়নের পরও শাস্তি হয়নি ফেলানীকে হত্যাকারী বিএসএফ সদস্যের। বিএসএফের আদালত তাকে বেকসুর খালাস দেয়। এর পর মামলা ভারতের সুপ্রিম কোর্টে গড়ালেও সেখানে শুনানি হয়নি আজও। বিচার না পেয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ ফেলানীর মা জাহানারা বেগম বলেছিলেন, এমনভাবে কেউ যেন তাঁর সন্তানকে না হারান। একটি পাখিও যেন বিএসএফের হাতে মারা না যায়। কিন্তু বিএসএফ তো মানুষই মারছে পাখির মতো!
এসব ঘটনা থেকে স্পষ্ট, যত বন্ধুত্বের কথাই বলা হোক, সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় ভারতের আচরণ আগ্রাসী প্রতিবেশীর। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশের সীমান্তে আধিপত্যবাদী আচরণ করা ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ 'বৈরী' প্রতিবেশী চীন বা পাকিস্তানের নাগরিকদের ক্ষেত্রে এভাবে ধারাবাহিকভাবে নির্বিচারে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটায় না। সেখানে যুদ্ধাবস্থা থাকতে পারে। বিচ্ছিন্নভাবে গোলাগুলি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় যা হয়; একতরফা ধারাবাহিক সীমান্ত হত্যা নেই।
সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চললেও বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে কড়া প্রতিবাদের ঘটনা বিরল। সীমান্তে বিএসএফের নিয়মিত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কড়া ও স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া, প্রতিটি ঘটনার বিচার ও তদন্ত দাবি করা, ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে জবাবদিহি চাওয়া এবং প্রয়োজনে বারবার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বিষয়টিকে দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত করার কোনো চেষ্টাই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় না। যেন বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি অন্য আরও অধিকারের মতো নাগরিকের জীবনের অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্বও নিতে অস্বীকার করছে!
সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে হলে ভারতের ওপর দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ফোরামে কার্যকর চাপ প্রয়োগ এবং সীমান্ত হত্যার প্রতিটি ঘটনার তদন্ত ও বিচারের ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে বাংলাদেশকে।
কল্লোল মোস্তফা: লেখক, প্রকৌশলী, নির্বাহী সম্পাদক, সর্বজনকথা