ইতিহাসের গতি বদলে দেওয়া ঘটনাবলির দিকে তাকালে দেখা যাবে, এ লক্ষ্যে প্রণীত প্রস্তাবাবলি বিষয়ে দলীয় নেতার পরামর্শ ও নির্দেশ গ্রহণের পাশাপাশি সংশ্নিষ্ট রাজনৈতিক দল একনিষ্ঠ গবেষণাও পরিচালনা করে। এর অংশ হিসেবে নেওয়া হয় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ। সংশ্নিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত চুলচেরা বিশ্নেষণ করে তা জনসাধারণের উপযোগী করে হাজির করা হয়। রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম যে শুধু দলীয় সভা-সমাবেশ, নির্বাচনে অংশ নেওয়া আর ক্ষমতায় যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়- এ বিষয়ে উপমহাদেশের রাজনীতির বাইরে আমেরিকা ও কানাডার দিকে তাকালেও কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। সেখানে রাজনৈতিক দলকে তাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে জনসাধারণের কাছে যেতে হয়। গিয়ে বোঝাতে হয়- কেন তাদের দল ব্যতিক্রম; কেন তাদের ভোট দেওয়া দরকার; তারা ক্ষমতায় গিয়ে দেশের গুণগত কী পরিবর্তন করতে পারবে। এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় রাজনৈতিক দলকে। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে রাষ্ট্রের মৌলিক কিছু বিষয়ে পরিবর্তনের কথাও সেসব প্রস্তাবে উঠে আসে।

বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে ৫০ বছর পেরিয়েছে। এত দিনে একটি দেশের নির্দিষ্ট মানদণ্ডে পৌঁছানোর কথা। বাংলাদেশ বেশকিছু ক্ষেত্রে সত্যি সত্যি অগ্রগতি দেখিয়েছে। কিন্তু দেশটিতে এই দীর্ঘ সময়েও যেটি হয়নি, তা হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো গুণগত পরিবর্তন। দেশ পরিচালনার ভার যাঁদের হাতে ন্যস্ত থাকে, তাঁরা কীভাবে নির্বাচিত হবেন- এই বিষয় নিয়ে এখনও রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। বিষয়টি মীমাংসা করা যেন দিন দিন কঠিন হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিকে আমি বলি যে দুটি ধারা- এ ও বি। 'এ' ফর আওয়ামী লীগ। 'বি' ফর বিএনপি। মোটা দাগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে বাংলাদেশে আর কোনো রাজনৈতিক জোট নেই। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যদিও ডান, বাম, ইসলামী নানা দলের নাম শোনা যায়। আবার নির্বাচন কমিশনের তালিকায় নাম লেখাতে নিবন্ধন পেতে আবেদনের তালিকা দেখেও বিচিত্র নাম দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত সব মিছিল গিয়ে থামে আওয়ামী লীগ-বিএনপি- এ দুই দুয়ারে। আওয়ামী লীগ ১৩ বছরেরও বেশি সময় টানা রাষ্ট্রক্ষমতায়। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এই ১৩ বছরে দেশ তিনটি জাতীয় সংসদ পেয়েছে। এর শেষ দুটিতে কাগজ-কলমে জাতীয় পার্টিকে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে দেখা গেছে। সবশেষে জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যানের দিকে তাকালে এই কাগুজে প্রধান বিরোধী দলের পরিণতি নিয়েও মন্তব্য করা যায়। জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের প্রধান কে হবেন- এ বিষয়ে সমাধান যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আসে, তখন বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির হাল বুঝতে কষ্ট হয় না।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে এভাবে টানা ১৫ বছরেরও বেশি সময় বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে অতীতে আর কখনও থাকেনি। অনেকেই মনে করেছিল, বিএনপি আর টিকবে না। বিশেষ করে দলটির চেয়ারপারসনের সাজা, অসুস্থতা, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিদেশে অবস্থান এবং দলটির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা-হামলায় দলটি নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু দেখা গেল, বিএনপি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজনীতিতে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে। রাজপথে লড়াই করছে। এই সময়ে এসে বিএনপি যে কাজটি করছে, তা হচ্ছে রাষ্ট্র রূপান্তরের একটি রূপরেখা প্রণয়ন। রাষ্ট্রের রূপান্তরমূলক পরিবর্তনে দলটি ২৭টি বিষয় নিয়ে এগিয়ে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে- সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন; জাতীয় সমঝোতা কমিশন গঠন; নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন; সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন; রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়ন; দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন; নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন সংশোধন; জুডিশিয়াল কমিশন গঠন; প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন; মিডিয়া কমিশন; ন্যায়পাল নিয়োগ; অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন; ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার- মূলনীতির ভিত্তিতে ধর্ম পালনে পূর্ণ অধিকার ও পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান; আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণ ও সুষম উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে দায়মুক্তি আইনসহ সব কালাকানুন বাতিল; বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া; দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুসংগঠিত করা; নিবিড় জরিপের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা প্রণয়ন ও যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদাদান; শ্রমিকদের প্রাইস-ইনডেক্স বেজড ন্যায্য মজুরি, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতসহ আরও কিছু বিষয় (সমকাল, ২৪ নভেম্বর ২০২২)।

এখানে লক্ষণীয়, বিএনপি যে রূপরেখা সামনে নিয়ে এসেছে তা মূলত রাষ্ট্র সংস্কার করারই ইঙ্গিত। বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল যখন রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই দেশের মানুষের মধ্যে এ নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। দেশের নাগরিকদের আওয়ামী লীগ-বিএনপিকেন্দ্রিক বিভাজনের মাঝে এই সংস্কার প্রস্তাব বেশ বার্তাবাহক বলে মনে হওয়ার সংগত কারণ আছে। যেখানে দেশে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থান খুব শক্ত, সেখানে বিএনপি সংস্কার প্রস্তাব দিয়ে নিজের পালে কতটা হাওয়া টানতে পারে, সেটিই এখন দেখার বিষয়। আমরা স্মরণ করতে পারি, বিচারপতি কেএম হাসান ৩৩ বছর আগে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আওয়ামী লীগ তাঁকে মানেনি। বিপরীতে যিনি এখনও আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাঁকে বিএনপি কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে মানবে?

এহ্‌সান মাহমুদ: সহ-সম্পাদক, সমকাল