পাকিস্তানে দুই বড় খেলোয়াড় সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলোচনায়। এ দুইজন হলেন এপ্রিলে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খান এবং বিদায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া। সম্প্রতি ইমরান খান স্বীকারোক্তির মতো বলেছেন, তাঁর সময়ে 'রিয়েল এস্টেট মাফিয়াদের' নিয়ন্ত্রণে আনতে তাঁর সরকার নাকানিচোবানি খেয়েছে। অন্যদিকে, অবসর-পূর্ব শেষ ভাষণে জেনারেল বাজওয়া গত সাত দশকে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এ হস্তক্ষেপকে তিনি 'অসাংবিধানিক' বলেও মন্তব্য করেন। একই সঙ্গে ভুল করা ও দাম্ভিক আচরণের জন্য রাজনীতিকদেরও সমালোচনা করেছেন। তাঁরা উভয়েই অবশ্য প্রতিজ্ঞা করেছেন- অতীতের ভুলের আর পুনরাবৃত্তি হবে না।

পাকিস্তানের এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয়ের গোপনীয়তা যেভাবে ভেঙে পড়ল, তাতে সাধারণ মানুষ কী ভাববে? রিয়েল এস্টেট কোম্পানি এতটাই শক্তিশালী যে, তারা যা ইচ্ছে করতে পারে! সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলতার এই নমুনা! একদিকে আইএমএফের শর্তের চাপ, অন্যদিকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট- এ দুই বিষয় এমনিতেই সাধারণ মানুষের কাছে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘার মতো। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের চাপে পিষ্ট মানুষ। এর সঙ্গে আরও নানা প্রশ্ন সামনে আসছে। হাজারো নিখোঁজ ব্যক্তির কী খবর? তারা কি ফিরে আসবে? এ বছর পাকিস্তানে যে ভয়াবহ বন্যা হয়ে গেল; যার প্রভাব মানুষ এখনও কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়নি। দুর্দশাগ্রস্ত সেসব মানুষের জন্য বরাদ্দের খবর কী? সম্প্রতি জাতিসংঘ বলেছে, পাকিস্তানে সাম্প্র্রতিক ভয়াবহ বন্যায় প্রায় ২৭ হাজার স্কুল ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে দেশটির ২০ লাখেরও বেশি শিশু তাদের স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনে ফিরে যেতে পারছে না।

যা হোক, আমরা সামরিক বাহিনী ও রাজনীতির বিষয়ে আসি। জেনারেল বাজওয়া কয়েক দিন পরই সেনাপ্রধান হিসেবে অবসরে যাচ্ছেন। সে কারণে তাঁর মন্তব্য কতটা তাৎপর্যপূর্ণ কিংবা এর প্রভাব কতটা পড়বে, তা বলা যায় না। তবে বিষয়টি ওপেন সিক্রেট এবং এ নিয়ে অনেকেই কথা বলেছেন। জেনারেল বাজওয়ার স্বীকারোক্তির মাধ্যমে সেটি আরও স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ব্যবসায়িক আগ্রহের বিষয়টি আরও জোরোলোভাবে প্রমাণিত হলো এবং আমি মনে করি, বাজওয়ার বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। অন্যদিকে ইমরান খান অব্যাহতভাবে বলে যাচ্ছেন, তিনি শিগগিরই তাঁর পদে ফিরবেন। তার মানে, তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের কথাই বলছেন। কিন্তু তাঁকে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে কি আরেকবার সুযোগ দেওয়া উচিত? এর আগে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) পিএমএল-এন এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি-পিপিপিকে এমনিভাবে অনেক সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ইমরান খান অবশ্য আমাদের এ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, তিনি রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করছেন না এবং সত্যিকার অর্থে তাঁকে আরেকবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করা দরকার।


কিন্তু পিটিআই পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুক বা না করুক; দলটি পিএমএল-এন, পিপিপি কিংবা অন্য দলগুলোর মতো রাজনৈতিক খেলায় অর্থকেই শক্তিশালী করেছে। কয়েক বছর আগে আবিদ হাসান মিন্টোর করা রিটে সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দিয়েছেন এই বলে, জাতীয় পরিষদের একটি আসনে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য সর্বোচ্চ ৪০ লাখ রুপি ব্যয় করতে পারবে (বাংলাদেশের হিসাবে যা ২০ লাখ টাকার মতো)। অথচ বুর্জোয়া দলগুলো কয়েক কোটি টাকাও খরচ করে। রিয়েল এস্টেট মোগল তথা আবাসন খাতের বড় বড় কোম্পানিসহ পুঁজিবাদী লবিগুলো শক্তিশালী হওয়ার এটি অন্যতম কারণ। নির্বাচনে টাকা কথা বলে। বলাবাহুল্য, এটি শুধু পাকিস্তানেরই সংকট নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করপোরেট লবিগুলো জাতির সঙ্গে মশকরা করে। পুঁজিবাদবিরোধী শক্তির জন্য নির্বাচন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয় না। এখানেই নীতির প্রশ্ন। বিগত কয়েকটি দশকে পাকিস্তানজুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো বেড়েছে আবাসন প্রকল্প। বিশেষ করে পারভেজ মোশাররফের সময়ে এবং তারপর তাদের দাপট ও প্রসার বেড়েছে। আইএমএফ ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের আর্থিক উদারীকরণ নীতির ফলে বিষয়টি আরও শক্ত ভিত্তি পেয়েছে। যে কারণে বড় পুঁজির কোম্পানিগুলো শ্রমিকদের অধিকারকে পাত্তা দেওয়া বন্ধ করে, পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে কোনো ভাবনার ধার ধারতে নিরুৎসাহ দেখায়। ঠিকঠাক কর-শুল্ক্ক দেওয়ার ব্যাপারেও তাদের মধ্যে অনীহা দেখা যায়। কোম্পানিগুলো এভাবে ব্যাপক অর্থ লাভ করছে। ঔপনিবেশিক লিগাসির কারণে পাকিস্তানেও ধনীরা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা নিয়ে শ্রমজীবী মানুষদের অধিকারহারা করতে থাকে। এর মধ্যে আসে নয়া উদারীকরণ নীতিমালা, যার অধীনে ওই ধনীদের পক্ষে সরকারি-বেসরকারি ভূমি দখল এবং প্রাকৃতিক সম্পদ নিজেদের কবজায় নেওয়া সহজ হয়।

এমনকি একসময় উপকারী পুঁজিবাদ বলে যে বিষয়টির প্রসার ঘটছিল, সেটিও এখন লুপ্তপ্রায়। আবাসন কোম্পানিগুলোর লাভ ব্যাপকভাবে বাড়ছে। ফলে পাকিস্তানের উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ কমছে, অথচ উৎপাদন খাত একই সঙ্গে ব্যাপক কর্মসংস্থানেও ভূমিকা রাখতে পারত। একই কারণে পাকিস্তানি প্রবাসীদের ধনিক শ্রেণিও দেশে ফিরে আবাসন খাতে বিনিয়োগ করছে। ইমরান খানের যে বিষয়টি ভোলা উচিত নয় সেটি হলো, তিনি আবাসন খাত ও অবকাঠামোগত নির্মাণ খাতে টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, তিনি বিষয়টি দেশে ও বিদেশে তাঁর সমর্থকদেরও বলেছিলেন। এটাও বলা জরুরি, আবাসন উদ্যোগগুলোর অনেকের সঙ্গে খাকি রংওয়ালারাও জড়িত। সামরিক বাহিনীর এই যুক্ততার ফলে এদের নিয়ন্ত্রণ আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।

সুতরাং, আমরা আবার সেই আলোচনায় ফিরি। প্রশ্ন হলো, সবাই একই রকম হলে আমরা ভিন্ন প্রত্যাশা করব কীভাবে? সত্যিকার অর্থে এখন আমাদের প্রয়োজন অন্তত ইমরান খানের তারুণ্যদ্দীপ্ত সমর্থকরা তা ভাবতে পারে- একটা বাম-প্রগতিশীল বিকল্প, যারা বিশেষ বিশেষ বিষয়ে অনুশোচনা প্রকাশ না করে সামগ্রিকভাবেই জনগণের আস্থাভাজন হতে চাইবে।

আসিম সাজ্জাদ আখতার: পাকিস্তানের কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক; ডন থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক