দেশে একটা সময় ছিল- বিশেষত গত শতাব্দীর সমাপনী ও চলমান শতাব্দীর সূচনার দিকে; যখন নারীর বিরুদ্ধে এসিড সন্ত্রাস ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করিয়াছিল। প্রত্যহ একাধিক নারী দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে বিকৃত মানসিকতার পুরুষ দ্বারা সংঘটিত কুৎসিত আক্রমণের শিকার হইত। তবে ২০০২ সালে এসিড সন্ত্রাস প্রতিরোধে কঠোর আইন; যেখানে শুধু অপরাধী নহে, অপরাধীর সাঙাতকেও মৃত্যুদণ্ড প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হইয়াছে- প্রণয়ন, তৎসহিত সচেতন নাগরিক সমাজের উক্ত সন্ত্রাসবিরোধী সোচ্চার কণ্ঠের কারণে আক্রমণের সংখ্যা হ্রাস পাইতে থাকে। যেমন নারী অধিকার সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এতদ্‌-সংক্রান্ত তথ্যভাণ্ডারকে উদ্ৃব্দত করিয়া শুক্রবার সমকাল লিখিয়াছে, চলমান বৎসরের প্রথম ১০ মাসে দেশে এসিড সন্ত্রাসের শিকার হইয়াছেন ১৫ জন নারী। এই সংখ্যাটা গত বৎসর ছিল ২২ এবং ইহার পূর্বের বৎসরে ২১। নারীর বিরুদ্ধে এহেন গুরুতর অপরাধের নিম্নমুখী প্রবণতা প্রত্যক্ষ করিয়া জনমনে একটা স্বস্তির ভাব পরিস্ম্ফুট অস্বাভাবিক নহে। কিন্তু সম্প্রতি এই রূপ স্বস্তির মধ্যেই একটা উদ্বেগ চাড়া দিয়া উঠিয়াছে। কারণ এসিড সন্ত্রাসের মামলায় অধিকাংশ অপরাধী খালাস পাইয়া যাইতেছে। এসিড সন্ত্রাসবিষয়ক বেসরকারি নজরদারি সংগঠন এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনের বরাত দিয়া সমকালের প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, ২০০০ হইতে ২০১৯ সাল অবধি দেশে প্রায় ১৫ শত নারী-শিশু এই অপরাধের শিকার হইলেও শাস্তি হইয়াছে মাত্র ৩৪৩ জনের। অর্থাৎ মাত্র ৯ শতাংশ মামলায় অপরাধীর শাস্তি হইয়াছে। দণ্ডপ্রাপ্তির এই নিম্নহারের পরিপ্রেক্ষিতে কেহ যদি বলিয়া থাকেন, এসিড সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে দেশে এক প্রকার বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিদ্যমান, তাহাকে ভুল বলা যাইবে না। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফল যে অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া- উহা বুঝিতে কোনো মানুষকে বিশেষজ্ঞ হইতে হইবে না।

সংশ্নিষ্ট আইনজীবীদের ধারণা, প্রথমত দুর্বল এজাহারের কারণে এসিড সন্ত্রাসবিষয়ক মামলা হীনবল হইয়া পড়ে। উহার সহিত যুক্ত হয় বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, অপরাধীদের সামাজিক ও পেশিশক্তির অশুভ প্রভাব। ফৌজদারি মামলা হওয়ায় সরকারি কৌঁসুলিরাই বাদীপক্ষ। অভিযোগ রহিয়াছে, অনেক ক্ষেত্রে তাঁহারা বিবাদীগণের সহিত অনৈতিক সম্পর্ক গড়িয়া ভুক্তভোগী ও সাক্ষীগণকে ধার্য দিবসে আদালতে হাজির করিবার প্রশ্নে উদাসীনতা প্রদর্শন করেন। ভুক্তভোগীকে আইনি সহায়তা প্রদান; তৎসহিত এসিড সন্ত্রাস পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের নিমিত্তে ২০০২ সালের আইন মানিয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে এবং প্রশাসন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয় কাউন্সিল গঠন করা হইয়াছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, একজন নারী অধিকার কর্মী যেমনটা অভিযোগ করিয়াছেন, তিন মাস পরপর বৈঠকের কথা থাকিলেও উক্ত কাউন্সিল গত কয়েক বৎসরে একবারও সভা করিতে পারে নাই। আমাদের ধারণা, পূর্বের তুলনায় দেশে এসিড সন্ত্রাসের ভযাবহতা হ্রাস পাইবার কারণে জাতীয় এসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের নিয়মিত বৈঠক আয়োজনে এমন শৈথিল্য আসিতে পারে। কিন্তু ইহা যে এসিড সন্ত্রাসীদের জন্য এক ধরনের প্ররোচনাস্বরূপ, তাহাও বিস্মৃত হইলে চলিবে না। শুধু উহাই নহে, এমনিতেই সামাজিক কালিমা ও সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতার কারণে অনেক ভুক্তভোগী ও তাঁহার স্বজনদের মধ্যে এসিড সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন ঘটনা গোপন রাখিবার প্রবণতা কাজ করিয়া থাকে; উপরন্তু আমাদের বিচারব্যবস্থা অনেকাংশে বিচারপ্রত্যাশীবান্ধব না হইবার কারণে অনেক ভুক্তভোগী আদালতের দ্বারস্থ হইবার ক্ষেত্রে ইতস্তত বোধ করিয়া থাকেন। উপর্যুক্ত বিচারহীনতার সংস্কৃতি নিঃসন্দেহে এহেন পরিস্থিতিকে অধিকতর প্রতিকূলতার দিকে লইয়া যাইতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে সমাজের প্রায় সর্বক্ষেত্রে শত শত বৎসর ধরিয়া যে পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য চলিতেছে, রাষ্ট্রও দুর্ভাগ্যজনকভাবে উহা হইতে মুক্ত নহে। ১৯৭১ সালে শুধু পুরুষ নহে, অসংখ্য নারীর অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়া প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্র উহার যাত্রাকালে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল প্রকার বৈষম্য নিরসনের অঙ্গীকার সত্ত্বেও এহেন পরিস্থিতি বিরাজ করিতেছে। ফলে, আমাদের প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থাও ঐ পুরুষতন্ত্রের কুপ্রভাব হইতে মুক্ত হইতে পারিতেছে না। আমাদের বক্তব্য হইল, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ অনুযায়ী, 'নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে' বর্তমান সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। অতএব, সংশ্নিষ্ট সকল সরকারি সংস্থাকে এসিড সন্ত্রাসের শিকার নারীদের ন্যায়বিচারপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণে উদ্যোগী হইতে হইবে।