গত কয়েক দিন আগের ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক মেয়েশিশুর নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ল। সামাজিক যোগাযোগের এই প্ল্যাটফর্ম নিয়ে নানা সমালোচনা থাকলেও মাঝেমধ্যে এখানে এমন নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি এবং প্রাপ্তিস্বীকারের খবর দেখে আশাবাদও জেগে ওঠে। আয়াত নামে ৫ বছরের শিশুটির যে ছবিটি ফেসবুকে সন্ধান চেয়ে পোস্ট করা হয়েছে, সেখানে তাকে আর্জেন্টিনার জার্সি পরিহিত অবস্থায় দেখা গেছে। ফুটবল বিশ্বকাপের মৌসুমে শিশুটি হয়তো আর্জেন্টিনার জার্সি শরীরে চাপিয়ে ছবি তুলেছিল। আয়াতের নিখোঁজ হওয়ার খবর দেখে প্রথমে আমার বিশেষ কিছু মনে হয়নি। মাঝেমধ্যে ফেসবুকে এমন নিখোঁজদের ছবি দেখা যায়। আবার ফিরে পাওয়ার খবরও জানা যায়। এবারও তেমনই মনে হয়েছিল। কিন্তু ঘটনার ১০ দিন পর দেখা গেল, নিখোঁজের ঘটনাটি সাধারণ কোনো ঘটনা নয়। জানা গেল, শিশু আয়াতের ছোট্ট দেহটি আর অক্ষত নেই।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ৫ বছর বয়সী ছোট্ট শিশু আলিন ইসলাম আয়াত বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকত চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড থানার বন্দরটিলার নয়ারহাট এলাকার একটি বাসায়। গত ১৫ নভেম্বর বিকেলে বাসা থেকে মসজিদে আরবি পড়তে বের হয় আয়াত। এর পর থেকেই তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরিবারের লোকজন অনেক জায়গায় ধরনা দিয়েও শিশুটির আর খোঁজ পাননি। থানায় নিখোঁজের ডায়েরিও করেছিলেন বাবা সোহেল রানা। শেষ পর্যন্ত নিখোঁজের ১০ দিন পর শিশু আয়াতের নিখোঁজ রহস্যের জট খুলেছে। মুক্তিপণের জন্য অপহরণের পর ফুটফুটে শিশুটিকে শ্বাসরোধে হত্যা করে দাদার বাড়ির সাবেক ভাড়াটিয়া আবির আলী। আর মরদেহ ছয় টুকরা করে আলাদা ব্যাগে ভরে নালা ও সাগরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এসব বর্ণনা দিয়েছে আয়াতকে অপহরণের অভিযোগে গ্রেপ্তার আবির নামে একজন। তবে এখনও নিহত শিশু আয়াতের মরদেহ উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে, নালা ও সাগরে ফেলা মরদেহের ব্যাগ জোয়ারের পানি ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

শিশু আয়াতের এমন করুণ পরিণতির সংবাদ জানার পর স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে।

আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজে শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে। কারণ তারা দুর্বল। তাই তারা সহিংসতার শিকার বেশি হয়। শিশুদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। নানা কাজে বাধ্য করা হয়। এতে তারা রাজি না হলে তাদের নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। মুক্তিপণের অর্থ আদায়ে শিশুদের ব্যবহার করা হয়। আবার গরিব ও নিম্নবিত্ত পরিবারে শিশুরা বেশি সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়। সমাজে বিচারহীনতা এবং অসুস্থ মানসিকতার প্রকাশ এই নির্মম শিশুহত্যা ও নির্যাতন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি শিকড় গেড়ে বসায় একটি শিশুকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করতে তারা আশকারা পেয়েছে। যারা এ কাজ করেছে, তারা ভয়ংকর বিকৃত মানসিকতার। এ কাজের মধ্য দিয়ে আমাদের অসুস্থ সমাজের চেহারা বেরিয়ে এসেছে। শিশুদের প্রতি সমাজ যে নির্দয়- আয়াতের করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে তারই প্রকাশ ঘটেছে। আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতরেই নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বীজ লুকানো। একটি শিশুকে ছোটবেলায় বেড়ে উঠতে দেখা তারই প্রতিবেশীর হাতে নির্দয়ভাবে জীবন দিতে হলো। আয়াতের হত্যাকারী হত্যাকাণ্ড সংঘটনের পর যেভাবে মরদেহ গোপন করার চেষ্টা করেছে, তাতে প্রমাণ হয় অপরাধীরা কতটা বেপরোয়া ও অমানবিক। শিশুদের জন্য নিরাপদ সমাজ ও রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে সমাজের সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। মানবিক হয়ে ওঠার শিক্ষা সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করে কঠোর বার্তা দিতে হবে।

এহ্‌সান মাহমুদ: সহ-সম্পাদক, সমকাল