- মতামত
- প্রকাশনা শিল্পের সংকট ও একুশে বইমেলা
প্রকাশনা শিল্পের সংকট ও একুশে বইমেলা

অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের পাঠক, লেখকসহ বাঙালির জন্য এক বিশেষ উপলক্ষ। একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে চলা এ মেলা শুধু বাংলাদেশে নয়; পুরো বিশ্বেই এখন অনন্য ঐতিহ্য। বক্তারা বলেন, বিগত দুটি বইমেলা করোনা মহামারির কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লেখক, পাঠক, প্রকাশকসহ সবার জন্যই এ সময় কঠিন ছিল। সম্প্রতি আবার অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাসের কারণে আসন্ন অমর একুশে বইমেলা-২০২৩ আয়োজন করার প্রাক্কালে আমাদের অনেক বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।
কাগজ সংকটের কারণে দেশে এখন মুদ্রণ কাজই থমকে গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বইয়ের দাম বৃদ্ধি হওয়ার আশঙ্কা এ বছর প্রবল। গত ছয় মাসে পাইকারি প্রতি টন কাগজের দাম বেড়েছে ৩৫ থেকে ৩৭ হাজার টাকা। গত বছর যে কাগজের রিম ১ হাজার ৭০০ টাকা ছিল, এবার তা ৩ হাজার ৪০০ টাকা হয়ে গেছে। অন্য কোনো খাতে পণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়নি। কাগজের দাম বৃদ্ধি পেয়ে তা দ্বিগুণ হয়ে গেল। আমরা দেখেছি, বইমেলা আর পাঠ্যবই ছাপার সময় এলে কাগজকল মালিকরা একত্রিত হয়ে কাগজের দাম বাড়াতে থাকেন। এর অবসান হওয়া উচিত। ডলার সংকটের কারণে বিদেশি কাগজের দাম বেশি হয়েছে- এটি মানা যায়। কিন্তু দেশে যে কাগজ উৎপাদিত হয়, তার দাম বেশি বেড়েছে। এটি আমাদের ওপর সবচেয়ে বড় চাপ। কাগজকল মালিকরা সিন্ডিকেট করে কাগজের দাম বাড়িয়েছেন। সরকার তা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে।
করোনা মহামারি ও সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দায় প্রকাশনা শিল্পের ক্ষতির কথা বিবেচনায় নিয়ে আসন্ন একুশে বইমেলায় স্টল ভাড়া সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করছি আমরা। কাগজের দাম নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। গত দুই বছর করোনা মহামারির ফলে দেশের প্রকাশনা শিল্প ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রভাবও পড়েছে দেশে। কাগজসহ প্রকাশনা সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক সবকিছুর (প্লেট, ছাপা, বাঁধাই) খরচ বেড়েছে। দুই বইমেলায় প্রকাশকরা পড়েছেন লোকসান ও ক্ষতির মুখে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ লেখক পাঠক প্রকাশক পরিষদের প্রস্তাবনা হচ্ছে- আসন্ন অমর একুশে বইমেলা-২০২৩ ছোট পরিসরে আয়োজন করতে হবে।
করোনা মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব, ডলারের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি, চলমান অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে পাঠক লেখক প্রকাশক সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। দৈনন্দিন দ্রব্যাদি ও অন্যান্য সাংসারিক প্রয়োজন মিটিয়ে বই কেনার সামর্থ্য এবার কতজনের থাকবে, সেটি এক প্রশ্ন। পাঠকের সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে প্রকাশকরা বইয়ের মূল্য নির্ধারণ করবেন। একজন পাঠক যেন তাঁর পছন্দের বইটি সংগ্রহ করতে পারেন- এটি অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে।
কাগজ সংকট ও অন্যান্য কারণে বই প্রকাশের সংখ্যা কমে গেলে লেখক-কবি-সাহিত্যিক যাঁরা আছেন তাঁরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বাংলাদেশে রয়্যালটি প্রদান নিয়ে লেখকদের নানা আপত্তি রয়েছে। বাংলাদেশ লেখক পাঠক প্রকাশক পরিষদ আশা করে, সব প্রকাশনা সংস্থা লেখকদের রয়্যালটি প্রদানে স্বচ্ছতা বজায় রাখবে।
একুশে বইমেলা ২০২৩-এর একটি খসড়া লেআউট প্রদর্শন করেছি। এই লেআউটকে আদর্শ ধরে নিয়ে মেলার ডিজাইন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে মেলার পরিসর ছোট হয়ে আসবে এবং পাঠক ও মেলায় আগতদের জন্য স্টল ও পুরো মেলা ঘুরে দেখার সুযোগ বাড়বে। প্রকাশকরাও লাভবান হবেন।
বইমেলায় নিরাপত্তার ইস্যুটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নিতে হবে এবং মেলায় আগতদের প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম সুশৃঙ্খল ও যথাযথ করতে হবে। ছুটির দিনে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। গাড়ি, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল ইত্যাদি যানবাহন পার্কিংয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে। সব প্রকাশনার জন্য একটি নির্দিষ্ট মাপের (১৬ ফুট বাই ৮ ফুট)স্টল বরাদ্দ করতে হবে। উদ্যানের পূর্বদিকে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের পাশে কোনো বইয়ের স্টল বরাদ্দ দেওয়া যাবে না। উল্লেখ্য, গত দুটি মেলায় সে স্থানে যেসব প্রকাশক স্টল বরাদ্দ পেয়েছিলেন, তাঁরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। বইমেলায় প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ- এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে টিএসসির গেট ও বাংলা একাডেমির গেটকে প্রাধান্য দিয়ে মেলার লেআউট করতে হবে।
বইমেলায় খাবারের দোকান নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সেই এলাকার বাইরে অন্য কোথাও খাবারের দোকান বরাদ্দ দেওয়া যাবে না।
বইমেলা চলাকালীন ঢাকা মহানগরীসহ ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে বিআরটিসির বাস সার্ভিস চালু করতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বই এবং সাহিত্য নিয়ে উৎসাহমূলক নানা আয়োজন করতে হবে।
শিশুদের জন্য মেলার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বতন্ত্র আঙিনা বরাদ্দ করতে হবে এবং তা যথাযথভাবে যথেষ্ট জায়গা নিয়ে শিশুদের উপযোগী করে সুশৃঙ্খল ও আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে হবে। লিটল ম্যাগের জন্য স্বতন্ত্র জায়গা বরাদ্দ এবং তা লিটল ম্যাগ সম্পাদকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে করতে হবে।
একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে আমাদের পাঠক-প্রকাশক-লেখক তথা সংস্কৃতজনের মধ্যে এক ধরনের উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। আয়োজক বাংলা একাডেমিকে তাই একুশে বইমেলা আয়োজন সফল করতে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতিসহ সমমনা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে।
প্রকাশক ও লেখক
মন্তব্য করুন