- মতামত
- জলবায়ু সম্মেলন পরিচালিত হয় জলবায়ু রাজনীতি দিয়ে
সাক্ষাৎকার: হাসিন জাহান
জলবায়ু সম্মেলন পরিচালিত হয় জলবায়ু রাজনীতি দিয়ে

আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বর্তমান দায়িত্ব গ্রহণের আগে তিনি ২০১৫ সালের জুন মাস থেকে প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর ছিলেন। এর আগে ২০০৫ সাল থেকে ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কর্মসূচি পরিচালক, ২০০১ সাল থেকে ড্যানিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির প্রধান আর্থসামাজিক উপদেষ্টা এবং ১৯৯৬ সাল থেকে বুয়েটের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেনিং নেটওয়ার্কের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন।
সমকাল: কপ২৭ আয়োজনে অন্যান্যবারের তুলনায় অংশগ্রহণকারী কি কম ছিল? বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে?
হাসিন জাহান: এবারের জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে উপস্থিতি কম হওয়ার বড় কারণ ছিল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের চিন্তা। যে কারণে অনেক মন্ত্রণালয় অংশগ্রহণের অনুমতি পায়নি। অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাও সীমিত করে দেওয়া হয়েছিল। তা ছাড়া সাধারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এবার তিনিও যাননি। তবে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, বন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে ছিলেন।
সমকাল: এর ফলে বাংলাদেশের ইস্যুগুলো উত্থাপনে কোনো সমস্যা হয়েছে?
হাসিন জাহান: বাংলাদেশের দিক থেকে আলোচ্যসূচিতে গুণগত পার্থক্য হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। গতবার ও এবার- আমি দুটো কপেই অংশগ্রহণ করেছি। মনে হয়েছে, কপ থেকে প্রতিবারই প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তি বেশ অপ্রতুল।
সমকাল: যেমন?
হাসিন জাহান: আমরা জলবায়ু বিপন্ন দেশ। কিন্তু কপে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিয়ন্ত্রণ থাকে মূলত ধনী ও ক্ষমতাশালী দেশগুলোর হাতে। সুতরাং আমরা যতই দাবি তুলে ধরি না কেন, সেটা অনেকাংশে পূরণ হয় না। এর আরেকটি কারণ হলো, জলবায়ু সম্মেলনগুলো পরিচালিত হয় রাজনৈতিক সংগঠনের মতো। বা বলা চলে কপ পরিচালিত হয় জলবায়ু রাজনীতি দিয়ে। এখানে সব দেশের সমঅধিকার নেই। বিশ্বের প্রভাবশালী ও নীতিনির্ধারক রাষ্ট্রের তুলনায় আমাদের অবস্থান অনেক দুর্বল। এটা স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ব রাজনীতির অংশ। এটাকে সরলভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়; অনেক অন্তর্নিহিত বিষয় থাকে।
সমকাল: এবারের সম্মেলনে তো 'লস অ্যান্ড ড্যামেজ' চুক্তি হওয়ার বিষয়টিকে বিপন্ন দেশগুলোর বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
হাসিন জাহান: এই দাবি গতবার থেকেই ছিল যে, এবারের কপে লস অ্যান্ড ড্যামেজ মুখ্য আলোচ্য বিষয় হবে। এটা আমরা করতে পেরেছি। জলবায়ু বিপন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি প্রাপ্তি হলো, বিশ্বনেতারা এই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। যাঁরা জলবায়ু প্রভাবের অভিঘাতে বিপন্ন, তাঁদের জন্য এটা আশার আলো। কিন্তু হিসাবটা কী পদ্ধতিতে করা হবে, তা এখনও নির্ধারণ হয়নি। আশা করা যাচ্ছে, আগামী কপে পদ্ধতিটা নির্ধারিত হবে।
সমকাল: বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর এখন করণীয় কী?
হাসিন জাহান: আমাদের বড় প্রস্তুতিমূলক করণীয় রয়েছে। কারণ আমরা যদি লস অ্যান্ড ড্যামেজ প্যাকেজের আওতায় আর্থিক সহায়তা চাই তাহলে কী পদ্ধতিতে হিসাব-নিকাশ করতে হবে, সে পরামর্শ আমাদেরই দেওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমন্বয় রাখা দরকার। কারণ আমরা একভাবে চাইলাম; মালদ্বীপ আরেকভাবে চাইল; এমন হলে হবে না। এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থাকতে হবে, মানদণ্ড থাকতে হবে। সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ও তদারকি প্রক্রিয়া থাকতে হবে। পুরো বিষয়টি সমন্বিতভাবে দাঁড় করানো গেলেই তবে গ্রহণযোগ্য হবে।
সমকাল: বিষয়টি গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের মতো ঝুলে যাবে না তো?
হাসিন জাহান: যে পরিকল্পনা এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, আমার মনে হয় না সেখান থেকে ফেরার সুযোগ আছে। তবে কিছুটা বিলম্বিত হতেই পারে।
সমকাল: বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় মূল যে বিষয়, পৃথিবীর তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রির মধ্যে ধরে রাখা, সেটা নিয়ে কি কার্যকর আলোচনা সম্ভব হচ্ছে?
হাসিন জাহান: সত্যি বলতে কি, দেড় ডিগ্রির মধ্যে বা এরও কমে পৃথিবীর তাপমাত্রা ধরে রাখার বিষয়টি নিয়ে এবার খুব একটা আলোচনা হয়নি। এর প্রধান কারণ সম্ভবত জার্মানির সরে যাওয়া, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। কিন্তু এটা ধরে রাখা না গেলে আমরাসহ সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকব। ধনী দেশগুলো, যারা এখনও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপন্ন নয়, তারা হয়তো নিরাপদে থাকবে ভাবছে। তারা হয়তো ভাবছে, শুধু আমরা গরিব দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবো। বিষয়টা আসলে তেমন না। দেখেন, অস্ট্রেলিয়াতে দাবদাহ বাড়ছে, আমেরিকায় ঘূর্ণিঝড় বাড়ছে, ইউরোপের অনেক দেশে ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে। সুতরাং তারাও রেহাই পাবে- এমন কারণ নেই। এটি এক বৈশ্বিক দুর্যোগ।
সমকাল: ধনী দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পারছে না কি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর চাপে?
হাসিন জাহান: আপনি ঠিকই বলেছেন। ধনী দেশগুলোর অনেক সিদ্ধান্তই ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। জলবায়ু বিষয়ক সিদ্ধান্তগুলোরও অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়ী কমিউনিটি। টাকা যাদের হাতে ক্ষমতা তাদের কাছে এবং তারা বিভিন্নভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
সমকাল: বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক অর্থকরী প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারেরও দাবি উঠেছে এবারের কপে-
হাসিন জাহান: আমরা দাবি তুলছি; কিন্তু তা কতটুকু বাস্তবায়িত হবে, জানি না। কারণ এর সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। আর যে কোনো সংস্কার খুব দ্রুত হতে পারে না। অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তারা যদি সংস্কার করতে চায়, তাহলেও সময় দিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পর কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে, সেটাও আগে থেকে ভাবতে হবে। আমরা বলছি, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় সাধারণ ঋণ নয়। তাহলে সেটা আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। তাহলে বিকল্প কী? সেই প্রস্তাব আমাদের দিতে হবে এবং তাদেরকে গ্রহণ করতে হবে।
সমকাল: জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার বিষয়টি সামগ্রিকভাবে দেখার বদলে বাংলাদেশে আমরা কি অ্যাডাপটেশন বা অভিযোজনে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি?
হাসিন জাহান: অ্যাডাপটেশনে আমরা ভালো- এটা বলে বাহবা দিয়ে আমাদের এক ধরনের ঘোরের মধ্যে রাখা হয়েছে। আমরা হাততালি পাচ্ছি। জলবায়ু তহবিলের ৯৫ শতাংশ যাচ্ছে মিটিগেশন বা প্রশমনে, আর ৫ শতাংশ থাকে অ্যাডাপটেশনের জন্য। অথচ আমরা যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের সিংহভাগ দরকার অ্যাডাপটেশনের জন্য। এটাকে বাড়ানো না গেলে এই অ্যাডাপটেশনের মূল্য কী? ১৭-১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে দু'একটি উদাহরণ দিয়ে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করা যাবে না।
সমকাল: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'কেউ কথা রাখেনি' কবিতায় আছে- 'নাদের আলি, আমি আর কত বড় হবো?' আমরা আর কত অ্যাডাপটেশন করব?
হাসিন জাহান: ঠিকই বলেছেন, অ্যাডাপটেশনেরও একটি সীমাবদ্ধতা আছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অ্যাডাপটেশন এবং লস অ্যান্ড ড্যামেজ গুলিয়ে ফেলা যাবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় দুটো আলাদা স্তম্ভ। অ্যাডাপটেশন হচ্ছে যেটাকে আমি অভিযোজনের মাধ্যমে ঠিক রাখতে পারছি; অন্যদিকে লস অ্যান্ড ড্যামেজ হচ্ছে যে ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না; হারিয়ে ফেলেছি।
সমকাল: জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় আমরা নিজস্ব অর্থায়নে ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছি। এর আওতাধীন প্রকল্পগুলো নিয়ে অনেক অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে আসছে।
হাসিন জাহান: এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ যে আমরা এমন একটি তহবিল তৈরি করতে পেরেছি। আমরা গর্ববোধ করি। কিন্তু দেখা যায়, নানা কারণে ভালো উদ্যোগগুলো ভালো থাকে না। এর পেছনে সুশাসন ছাড়াও কারিগরি অনেক কারণ থাকে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে সায়েন্স আছে, পলিটিক্স আছে, পলিসি আছে। তিনটা মিলে জলবায়ু পরিবর্তন। এখানে যাঁরা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছেন; প্রকল্পগুলো অনুমোদন বা তদারক করছেন, তাঁরা এসব কারিগরি বিষয়ে অবগত কিনা, জানা দরকার। আমরা যখন প্রকল্প হাতে নিচ্ছি সেটা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষম কিনা? যেমন অনেক সময় আমরা মনে করি, গাছ লাগালেই সমস্যার সমাধান। কিন্তু আমরা সঠিক গাছটি লাগাচ্ছি কিনা, দেখা দরকার।
সমকাল: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জলবায়ু সম্মেলনে বিষয়টি আমাদের দিক থেকে কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে?
হাসিন জাহান: আমরা যাঁরা পানিসম্পদ নিয়ে কাজ করি, সবাই মিলে ২৬তম কপে পানিসম্পদ বিষয়ক একটি বড় প্যাভিলিয়ন করেছিলাম। এবারের কপের ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে- পানিসম্পদ ও পানির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়াদি নিয়ে গুরুত্ব সহকারে কাজ করতে হবে। অ্যাডাপটেশনের ক্ষেত্রেও পানিসম্পদ যে গুরুত্বপূর্ণ, তা আগে উল্লেখ করা হয়নি। এবার বিষয়টি বলা হয়েছে, আমার কাছে এটা বড় প্রাপ্তি। এবার আরও যে বিষয়টি ভালো লেগেছে তা হলো, পানিসম্পদ নিয়ে আন্তর্জাতিক নেতারাও আলাদাভাবে কথা বলেছেন। যাঁরা কৃষি নিয়ে কাজ করেন, তাঁরাও কথা বলেছেন। তার মানে, পানিসম্পদের গুরুত্বের বিষয়টি সব পক্ষ উপলব্ধি করতে পেরেছে।
সমকাল: জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় আমাদের দেশে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় কী করতে হবে?
হাসিন জাহান: আমরা শুধু বৈদেশিক সহায়তার ওপর ভরসা করে বসে থাকব না। আমাদের নিজেদেরও পরিকল্পনা থাকতে হবে। আমাদের দেশে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ রয়েছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন- এগুলো প্রতিরোধে আমরা কী করব, সে ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আমরা একটা হিসাব করে দেখার চেষ্টা করেছিলাম, প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সরকারের কী পরিমাণ টাকা ব্যয় হচ্ছে। সরকারের পরিকল্পনায় যদি খরচের বিষয়টি নির্ধারণ করতে পারে, তাহলে বরাদ্দ অর্থ বণ্টনের সুবিধা ও দক্ষতা বাড়বে।
সমকাল: কোনো উদাহরণ দিতে পারেন?
হাসিন জাহান: আমরা শুধু ওয়াটার ইনফ্রাস্ট্রাকচার নিয়ে একটি সমীক্ষা করেছি। আমরা দেখিয়েছি, এই যে ঘূর্ণিঝড়, বন্যার সময় যদি টয়লেট ব্যবস্থা পরিকল্পিতভাবে করা যায়, তাহলে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। একটু সংস্কার করলেই হয়ে যায়। যদি আগে থেকে পরিকল্পিত ও রেজিলিয়েন্ট অবকাঠামো থাকে, তাহলে দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি কমে আসবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় পরিকল্পনা দরকার।
সমকাল: সামগ্রিক পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি কি কম মনোযোগ পায়?
হাসিন জাহান: এ ব্যাপারে আমরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগী। সামগ্রিক পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিন্তা করলে এর মধ্যে নদীভাঙন, দূষণ থেকে শুরু করে সব বিষয় চলে আসে। কিন্তু আমাদের শুরু করতে হবে কোথা থেকে? সরকারের আইন বা নীতিমালার অভাব বা দুর্বলতা নেই। পানি আইন ২০১৩, পানি বিধিমালা ২০১৮-তে পরিস্কার বলা আছে কার দায়িত্ব কী, কার অধিকার কী। শুধু পানি বিধিমালা ২০১৮ যদি বাস্তবায়ন করতে পারতাম, আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতাম। যেমন আমাকে প্রথমে খাবার পানি নিশ্চিত করতে হবে। এর পর অন্য ধাপে যেতে হবে। যেমন ৫ শতাংশের কম হচ্ছে খাবার পানি; ৮০ শতাংশ কৃষি ও নৌচলাচলের জন্য। ফলে নৌ চলাচল ও সেচের পানি নিশ্চত করার পাশাপাশি দূষণ বন্ধ করতে হবে। এই যে ঢাকা ওয়াসা যে পানি শোধন করে, তাতে হয়তো জীবাণু নেই, কিন্তু দুর্গন্ধ আছে। কারণ পানি বিশুদ্ধ করতে গিয়ে অনেক বেশি রাসায়নিক ব্যবহার করতে হয়। আমরা যদি দূষণ বন্ধ করতে পারতাম, তাহলে বিশুদ্ধ করতে এত খরচ লাগত না।
সমকাল: জলবায়ু পরিবর্তনসহ যে কোনো দুর্যোগই তো নারীর জন্য বাড়তি বিপদ ডেকে আনে।
হাসিন জাহান: অবশ্যই। যেমন পানি নিয়ে আমরা অনেক কথা বলি। কিন্তু পানির মূল ব্যবহারকারী নারী। উপকূলীয় এলাকায় গেলে দেখবেন, একজন মেয়ে ৫-৭ কিলোমিটার দূর থেকে ২ কলস পানি নিয়ে আসছে। ওটা দিয়ে সারাদিন পরিবার চলছে। যে মেয়েটা কষ্ট করে এত দূর থেকে পানি নিয়ে এলো, সে কিন্তু সবচেয়ে কম পানি পান করে। ফলে নানা অসুখে ভোগে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নারীকে দূরে ঠেলে রাখার কারণে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে।
সমকাল: বন্যা বা নদীভাঙনের ক্ষেত্রেও আমরা দেখি, নারীই সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে।
হাসিন জাহান: বন্যা হলে নারীকেই বেশি ঝুঁকি নিতে হয়। বসত ঘরে পানি ঢুকলে নারীই প্রথম চৌকি বা খাট উঁচু করে টিকে থাকার চেষ্টা করে। আরও বেশি পানি হলে টিনের ঘরের চালে আশ্রয় নেয়। এক পর্যায়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যায়। কিন্তু সেখানে নারীর জন্য টয়লেট থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক সুবিধা থাকে না। প্রাইভেসি বলতে যা বোঝায়, তার কিছুই এসব আশ্রয়কেন্দ্রে থাকে না। আমরা মনে করি, কিছু ত্রাণ পাঠালেই সব দায়িত্ব শেষ হয় না। একজন নারীর জন্য স্যানিটারি প্যাড দরকার হতে পারে- এটা ক'জন মনে রাখে! আবার মনে রাখলেও এটা আশ্রয়কেন্দ্রে কীভাবে ব্যবহার করবে, সেটা ভাবা হয় না।
সমকাল: জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় নদনদীর স্বাস্থ্য বা প্রবাহ ঠিক রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সেটা কি আমরা গুরুত্ব দিয়ে ভাবছি?
হাসিন জাহান: পানিসম্পদ নীতিমালায় পরিস্কার বলা আছে- আমাদের পর্যায়ক্রমে ভূপৃষ্ঠের পানিসম্পদে শিফট করতে হবে। আমি আগেই বলেছি, আমাদের দেশে ভালো নীতিমালা আছে; কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। কেন বাস্তবায়ন নেই? সারফেস ওয়াটার যখন আপনি ব্যবহার করবেন, এর ট্রিটমেন্ট খরচ বেশি হয়। সে কারণে প্রকল্প যাঁরা তৈরি করেন, তাঁরা সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে যেতে চান। শুধু নদীর পানি নয়, বৃষ্টির পানিও ধরা দরকার। এ ব্যাপারেও নীতিমালা আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নদীর অধিকার আছে তার প্রবাহের ওপর। নদী প্রবহমান। একে জীবন্ত সত্তা হিসেবে কল্পনা করা হয়। আমাদের উচ্চ আদালতও সেই ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু মূল সংকট বাস্তবায়নে।
সমকাল: জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব সম্পর্কে কিছু বলতে চান?
হাসিন জাহান: সংবাদমাধ্যমকে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে আরও বেশি কারিগরি ধারণা রাখতে হবে। যদি সুযোগ থাকে তাহলে কারিগরি দিকগুলো সম্পর্কে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন; বিশেষ করে যাঁরা এসব বিষয়ে কাজ করেন। কারিগরি দিকগুলো বুঝতে পারলে সাংবাদিকরা এ বিষয়ে আরও ভালো কাজ করতে পারবেন, লিখতে পারবেন- এটা আমার বিশ্বাস। সাংবাদিকরা কারিগরি বিষয়গুলো বুঝে লিখলে তা বিশেষজ্ঞদের চেয়ে বেশি কমিউনিকেটিভ হয়।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। সমকাল সবসময়ই পরিবেশ, পানিসম্পদ, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
হাসিন জাহান: আপনাদের ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন