
গত ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে গেছে। এই প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসেছিল বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের ফলে। রিজার্ভের ওপর চাপ, মূল্যস্ম্ফীতি, প্রবৃদ্ধির গতি শ্নথ হওয়া এবং বাণিজ্যিক ভারসাম্যে অস্থিতি সরকারকে বাধ্য করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের সাহায্য কামনা করতে। আইএমএফের মিশনটি দু'সপ্তাহেরও অধিক সময় বাংলাদেশে অবস্থান করে। মিশনটি বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে মতবিনিময় এবং এর ভিত্তিতে তাদের সুপারিশ লিপিবদ্ধ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উন্নত দেশগুলোর কাছে বিশ্ব অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। বিখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জে এম কিনস এই ব্যবস্থাপনাকেন্দ্রিক আলোচনায় পৌরোহিত্য করেন। এ নিয়ে যে দীর্ঘ আলোচনার সূত্রপাত হয় তাকে আমরা ব্রেটন-উডস কনভেনশন হিসেবে জানি। অর্থনীতিবিদ জে এম কিনস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'জেনারেল থিয়োরি অব এমপ্লয়মেন্ট ইন্টারেস্ট অ্যান্ড গ্রোথ'-এ কীভাবে একটি পুঁজিবাদী দেশ কঠোর অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বের হয়ে আসতে পারে, তারই পরামর্শ দিয়েছেন। পুঁজিবাদী বিশ্বে ১৯৩০-এর মন্দা জে এম কিনসকে ভাবিত করেছিল। তিনি মনে করতেন, বল্কগ্দাহীন বাজার অর্থনীতি ১৯৩০-এর ভয়াবহ মন্দা অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। মন্দা থেকে মুক্তিলাভে তিনি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। মন্দা দেখা দিলে শ্রমিক ও কর্মজীবী মানুষ চাকরি হারায়। উন্নত দেশে মন্দা অনুন্নত দেশের মন্দার তুলনায় ভয়াবহ রকম দুর্যোগ সৃষ্টি করে। উন্নত দেশগুলোয় পুঁজিবাদী বিকাশের ফলে ঐতিহ্যগত আয় অংশীদারিত্ব লোপ পায়। কিন্তু অনুন্নত দেশে আয় অংশীদারিত্বের জন্য প্রথাগত প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মহারা মানুষদের বেঁচে থাকায় সহায়তা করে। এসব দেশে মন্দার কারণে যদি কোনো কর্মজীবী মানুষ শহরে কর্মচ্যুত হয়, তাহলে তারা গ্রামে ফিরে যেতে পারে এবং সেখানে পারিবারিক গণ্ডিতে খাওয়া-পরার একটা ব্যবস্থা হয়। এ ধরনের ব্যবস্থা উন্নত দেশগুলোতে না থাকার কারণে মন্দার সময় মানুষ খুব কষ্টে পড়ে যায়। চিন্তার বিষয়, অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৈশ্ব্বিক বাজার প্রক্রিয়া ঢুকে পড়ার ফলে এসব দেশ নাজুক অবস্থায় পড়েছে। বাজারের আগ্রাসনে পরিবার, সমাজ ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে প্রথাগতভাবে যে সাহায্য পাওয়া যেত তা অনেকাংশেই ভেঙে পড়েছে। বিশ্বমন্দা দেখা দিলে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো সমস্যায় পড়ে যায়।
আইএমএফ মিশনের বাংলাদেশে অবস্থান শেষে গত ৯ নভেম্বর একটি সংবাদ সম্মেলন করে। তারা তাদের সফরটিকে প্রাথমিক তথ্য উদ্ঘাটন হিসেবে দেখেছে। এতে মনে হয়, তারা ভবিষ্যতে আরও গভীর অনুসন্ধান চালাবে। আইএমএফ প্রতিনিধি দল জানিয়েছে, তাদের বক্তব্য আইএমএফ নির্বাহী বোর্ডের বক্তব্য নয়। প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধানের ওপর নির্ভর করে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তার ওপর তারা একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করবে; তারপর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সম্মতির ওপর নির্ভর করে আইএমএফের নির্বাহী বোর্ডে উপস্থাপন করা হবে। বোর্ড এ ব্যাপারে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। সুতরাং আইএমএফের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা অনুমোদিত হয়ে গেছে বলে যাঁরা মনে করেন তাঁরা প্রকৃত অবস্থাটি তুলে ধরছেন না। আইএমএফের কাছ থেকে এ ঋণ পেতে হলে বাংলাদেশকে আরও কিছু কাঠখড় পোড়াতে হবে। আইএমএফের এই ঋণের ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার আসবে এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি ও এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি থেকে। বাকি অংশ ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার আসবে রেজিলিয়েন্স সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি-আরএসএফ থেকে। বাংলাদেশকে এই ঋণ সহায়তা প্রদান করা হবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং শক্তিশালী, ইনক্লুসিভ ও সবুজ প্রবৃদ্ধির জন্য। এর পাশাপাশি এই ঋণের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো দুস্থদের রক্ষা করা।
আরএসএফ থেকে প্রাপ্ত ঋণ ব্যবহার করা হবে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ুকেন্দ্রিক বিনিয়োগের প্রয়োজন মেটাতে। আরেকটি লক্ষ্য হলো লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর চাপ হালকা করা। জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ রহিত করতে যে আমদানি নিবিড় বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে এবং তার ফলে লেনদেনের ভারসাম্যে যে সমস্যা সৃষ্টি হবে তা মোকাবিলা করাই এ ঋণের আরেকটি লক্ষ্য। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এবং আইএমএফের টিম সম্মত হয়েছে সংস্কারের জন্য নীতি গ্রহণ করা হবে একটি ৪২ মাস দীর্ঘ নতুন ইসিএফ/ইএফএফ ব্যবস্থার মাধ্যমে।
নতুন ইসিএফ/ইএফএফ ব্যবস্থার লক্ষ্য হলো সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার এবং বিপদগ্রস্তদের রক্ষা করা। একই সময়ে কাঠামোগত বিন্যাস উৎসাহিত করা হবে। এটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সবুজ প্রবৃদ্ধির জন্য শক্তিশালী সমর্থন সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের প্রয়োজন বিশাল জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অর্থায়ন করা। এটি ঋণের অন্যতম লক্ষ্য। একই সঙ্গে রাজস্ব সম্প্রসারণ করে জলবায়ুর অগ্রাধিকারগুলোকে সহায়তা প্রদান। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ যে পরিকল্পনা নিয়েছে, তাকে সহায়তা করাও এ ঋণের অন্যতম লক্ষ্য। আইএমএফের স্টাফ পর্যায়ে যে মতৈক্য সৃষ্টি হয়েছে, সে জন্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সম্মতি এবং নির্বাহী বোর্ড পর্যায়ে অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করা হবে এবং কাঙ্ক্ষিত নির্বাহী বোর্ডের অনুমোদন পাওয়া যাবে। আইএমএফের স্টাফ মিশন মনে করে, করোনা মহামারি থেকে বাংলাদেশ যেভাবে অর্থনীতিতে উত্তরণ ঘটিয়েছিল; ইউক্রেনে রুশ হস্তক্ষেপের ফলে তা ব্যাহত হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্যের চলতি হিসেবে বড় ধরনের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পেয়েছে এবং মূল্যস্ম্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। এগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে শ্নথ করে দিয়েছে। আসলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুদিন ফিরিয়ে আনতে হলে এ বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে- সমস্যার মূল কারণ হলো চলতি হিসেবে বড় ঘাটতি, রিজার্ভ দ্রুত কমে যাওয়া এবং মূল্যস্ম্ফীতি। বাংলাদেশ এই মুহূর্তের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম হলেও দীর্ঘমেয়াদে কাঠামোগত বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। এসব কাঠামোগত ইস্যুর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হওয়া। বাংলাদেশকে সফলতার সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হবে ২০৩১ সালের মধ্যে। অতীতের সাফল্য এবং কাঠামোগত ইস্যুগুলো সমাধান করে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিতকরণ, ব্যক্তিগত বিনিয়োগ বৃদ্ধি, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে টিকে থাকার শক্তি অর্জন করতে হবে। এই লক্ষ্যগুলো যে সঠিক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এগুলোই বাংলাদেশের এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক সমস্যা। তবে মতপার্থক্য দেখা দেবে এগুলোর সমাধান কীভাবে সম্ভব, তা নিয়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত সমস্যার মধ্যে রয়েছে দুর্নীতির মতো মারাত্মক সমস্যা এবং উন্নয়ন অগ্রাধিকার নির্ণয়ে বিচার ক্ষমতাকে শানিত করা। একসঙ্গে অনেক মেগা প্রকল্প চালু হওয়ার ফলে এগুলোর ওপর সঠিক নজরদারি করা সম্ভব হয়নি।
আইএমএফ প্রতিনিধি দল ও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছে তার মূলকথা হলো, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা করা। আইএমএফের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আইএমএফের সমর্থনে একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে একমত হয়েছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের এই কর্মপরিকল্পনা আসলে কী তা কখনও স্পষ্টভাবে জানানো হয়নি। তবে আইএমএফ প্রতিনিধি দল মনে করে, এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে অর্থনীতির বহির্দেশীয় অবস্থান জোরালো হবে, স্পর্শকাতরতা হ্রাস পাবে এবং শক্তিমান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি জোরদার হবে। যে পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ১. অধিকতর প্রসারিত রাজস্ব ভিত্তি তৈরি করা। বেশি করে রাজস্ব আহরণ এবং খরচপত্র যৌক্তিক করতে হবে। সমাজের দুর্বল শ্রেণির ওপর যে অভিঘাত সৃষ্টি হবে, সেগুলো প্রশমিত করতে সামাজিক ব্যয় বাড়াতে হবে এবং সঠিক লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। ২. মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থিক নীতি কাঠামোর আধুনিকায়ন করতে হবে। মূল্যস্ম্ফীতিকে বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে হবে। মুদ্রানীতির আধুনিকীকরণের ফলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে এবং এর ফলে সরকারি নীতির বাস্তবায়ন সহজতর হবে। মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় করতে হবে। যার ফলে বহির্বিশ্ব থেকে উদ্ভূত সমস্যা মোকাবিলা সম্ভব হবে। ৩. আর্থিক খাতকে বলীয়ান করতে এর স্পর্শকাতরতা হ্রাস, দেখভাল জোরদার, সুশাসন নিশ্চিত এবং প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য সমর্থন করার জন্য নিয়ন্ত্রণ কাঠামো এবং পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করে অর্থায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। সহজ ভাষায় বলতে হয়, পুঁজিবাজারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দিতে হবে। ৪. প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করতে হলে এমন একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে; যার ফলে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ; বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ; আর্থিক খাত গভীর; মানবিক পুঁজির বিকাশ এবং সুশাসন নিশ্চিত করে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত হবে। এগুলো করা সম্ভব হলে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাবে। ৫. জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে টিকে থাকার শক্তি-প্রতিষ্ঠানগুলো এবং সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলে জলবায়ু সংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। জলবায়ুজনিত অভিঘাত মোকাবিলায় বৃহৎ মাত্রায় জলবায়ু-বিনিয়োগ এবং অতিরিক্ত অর্থ সংস্থান করতে হবে।
আইএমএফ প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের অর্থনীতির এই মুহূর্তের সমস্যাগুলো সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছে। আইএমএফ করণীয় সম্পর্কে যে প্রাথমিক পরামর্শ দিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হলেও অধিক অর্থ প্রয়োজন। কারণ অতীত থেকে সৃষ্ট অর্থনীতির বর্তমান কাঠামো পরিবর্তন করতে হলেও অর্থ ব্যয় করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা নানা রকম কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারি। বিনিয়োগকৃত পুঁজির নমনীয়তার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক কাঠামো সংস্কারের চিন্তা করা যেতে পারে। যুদ্ধের জন্য ট্যাঙ্ক তৈরি করতে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, সেই প্রযুক্তি দিয়ে এক্সক্যাভেটর এবং রোড রোলার তৈরি করা সম্ভব। সৃজনশীলভাবে চিন্তা করতে হবে কীভাবে পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিন্যাসটি পরিবর্তন করে নতুন ধরনের বিন্যাস নির্মাণ করা সম্ভব। আইএমএফ আয় বর্ধনের জন্য অপ্রয়োজনীয় এবং অগ্রাধিকারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় এমন ধরনের খরচ পরিহারের কথা বলেছে। ব্যয় সংস্কার করতে হলে জাতীয় অগ্রাধিকারের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে দেখেছি, বাংলাদেশে অনেক ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যেগুলো নির্মাণের পর চালু করা হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি, এসব ক্ষেত্রে যে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ করা হয়েছে তা পুরোমাত্রায় পচনশীল বিনিয়োগে পরিণত হয়েছে। বিদেশ থেকে আনা চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহার করতে না পারা; সেতু নির্মাণ করে সংযোগ সড়ক তৈরি না করা; রাজধানীসহ অন্যান্য শহরে একই রোড ডিভাইডার বারবার পরিবর্তন এবং ফুটপাত বারবার ভাঙাগড়া প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। অভিযোগ আছে, দলীয় কর্মীদের হাতে অর্থ ধরিয়ে দেওয়ার জন্যই অপ্রয়োজনীয় গ্রামীণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ ধরনের প্রকল্প দুর্নীতিকে মাঠ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় সমস্যা হলো সম্পূরক উপকরণের জোগান দিতে ব্যর্থতা। বিদ্যুৎ খাতে গত কয়েক বছরে যে বিনিয়োগ হয়েছে, তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বিতরণ ব্যবস্থায় ঘাটতি থাকার ফলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। উচিত ছিল উৎপাদন ক্ষমতা যৌক্তিকভাবে সৃষ্টি করে তার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সঞ্চালন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা। বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জ পূরণের বাধ্যবাধকতা অর্থনীতিতে মারাত্মক ক্ষরণ সৃষ্টি করেছে। এর ফলে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি অর্থ ব্যয় না করেও প্রচুর অর্থের মালিক হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে অনাসৃষ্টি করা হয়েছে, তা থেকে অবশ্যই আমাদেরকে মুক্ত হতে হবে। পুঁজি পাচার রোধে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনার কথা ভাবা যায়। এসব করতে হলে জাতীয় সহমতের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। জাতীয় সহমত এই মুহূর্তে অতি জরুরি বিষয়। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক; মনে হচ্ছে, যাঁরা দেশ পরিচালনা করছেন, তাঁদের এ ব্যাপারে আগ্রহের ঘাটতি রয়েছে।
ড. মাহবুব উল্লাহ: অর্থনীতিবিদ; প্রাক্তন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন