- মতামত
- 'নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে'
আনিসুল হক স্মরণে
'নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছ নয়নে নয়নে'

প্রায় সকল ধর্মমতে, আমানত খেয়ানতকারীর ভয়ংকর পরিণতির কথা থাকলেও হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি তৈরির কারিগররা তা মনে রাখে না। সেই প্রেক্ষাপটে 'অর্পিত দায়িত্ব'কে 'আমানত' জ্ঞান করে কর্তব্যনিষ্ঠায় আর সংবেদনশীলতায় প্রতিপালনেও যে ব্যক্তিকে চির মহিমান্বিত করতে পারে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমরা নিকট অতীতে পেয়েছি। আত্মবিশ্বাসী আগামী প্রজন্মের উন্মেষে দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী মানুষটিই আমাদের প্রয়াত আনিসুল হক, আমার 'আনিস ভাই'। প্রধানমন্ত্রীর সানুগ্রহে 'মেয়র' পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোনয়ন প্রাপ্তির দিন থেকেই এই তাড়নায় তিনি পথ চলেছেন নিরন্তর, সেই অর্থেই আমৃত্যু।
প্রিয় বন্ধুর স্বামী হিসেবে এক অম্ল-মধুর সম্পর্কের মধ্যেই আমাদের অনেক দিনের পারস্পরিক সমঝোতার পথচলা। কিন্ত তাঁর 'মেয়র' আনিসুল হক অধ্যায়টি এই চলনধারায় এক অভূতপূর্ব উজ্জ্বলতায় জাজ্বল্যমান। ক্রমাগত কর্মউদ্যোগ, কর্তব্যনিষ্ঠতা, মানবিক সংবেদনশীলতা আর সৎ সাহসের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। অতি দ্রুততার সঙ্গে অবিশ্বাসের মায়াজাল থেকে বের করে জনসংযোগে জনমত তৈরির মাধ্যমে জনসম্পৃক্ত কর্মউদ্যোগের জোয়ার তোলার এক আশা জাগানিয়া অধ্যায়, আমাদের জানা ইতিহাসে আবার যুক্ত করেন এই উদ্যমী স্বপ্নদ্রষ্টা প্রবাদপুরুষ। দ্রুতই এ কারণে সাধারণ্যে অসাধারণ হতে শুরু করেন 'নগরপিতা আনিসুল হক'।
'এ কাজ আমার নয়, অন্য কারও'- এই মতবাদ অস্বীকারের এক অদ্ভুত কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব তাঁকে 'যানজট নিরসনে'র মতো বিষয়েও উদ্যোগী করে তোলে। পরিকল্পিত গণচলাচল নিশ্চিতে রুট 'ফ্র্যাঞ্চাইজ' বা একত্রীকরণ, যথাযথ 'ইউলুপ বাস্তবায়ন' উদ্যোগ কিংবা 'সিগন্যাল' বিহীন চলাচল করিডোর, 'পদচারি বান্ধবতা' নিশ্চিতপূর্বক 'অযান্ত্রিক বাহন' আর 'হকার অন্তর্ভুক্ত' করিডোর নিশ্চিতকরণ অথবা 'বাস আর ট্রাকস্ট্যান্ড স্থানান্তর'-এর মাধ্যমে অযাচিত 'পার্কিংমুক্ত সড়ক ব্যবস্থাপনা' নিশ্চিতের মতো বিষয়গুলো বিনা দ্বিধায় নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন। প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে গুলশান-বনানী-বারিধারা জুড়ে পরীক্ষামূলক 'ঢাকার চাকা' প্রবর্তন, 'অঞ্চলভিত্তিক নিবন্ধিত রিকশার ব্যবস্থাপনা' অথবা 'সিসিটিভিভিত্তিক নিরাপত্তা বলয়' তৈরি ইত্যাদি এই ধারার কিছু বিশেষ বিশেষ উদ্যোগ ছিল, যার প্রত্যাশিত ধারাবাহিকতা তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে প্রায় স্থবির হয়ে যায়।
উল্লেখ্য, উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়নে নিয়োজিত তরুণ উপদেষ্টাদের সম্মানী প্রদান কিংবা 'হলি আর্টিজান'-এর ঘটনা-পরবর্তী জরুরি সিসি ক্যামেরা সংগ্রহের জন্য করপোরেশনের প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান না থাকায় বিচলিত না হয়ে বরং নিজস্ব তহবিল আর সামর্থ্যবান বন্ধুদের সহায়তায় দ্রুত বাস্তবায়ন করেছেন। এভাবেই 'সবাই মিলে সকলের তরে'- এই ধারণার কার্যত বাস্তবায়নের পাশাপাশি শুভ উদ্যোগে সবার স্বতঃস্ম্ফূর্ত অংশগ্রহণও তিনি নিশ্চিত করেছেন।
'মেয়র' নির্বাচনের ঠিক আগে যে 'মাঠরক্ষা আন্দোলনে'র সূচনা হয়েছিল, তাঁর অনুপ্রেরণায় উত্তর ঢাকা জুড়েই খেলার মাঠ-পার্ক উদ্ধার আর উন্নয়নের প্রকল্প নেন তিনি। জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রত্যাশা আর প্রস্তাবের প্রাধিকারে প্রতিটিতেই প্রক্ষালন কেন্দ্রসহ ২১টি পার্ক-খেলার মাঠ উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন পরবর্তী ব্যবস্থাপনাতেও 'অংশীজন অংশগ্রহণে পরিচালনা' ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হন। একই বিশ্বাসের ধারাবাহিকতায় 'জন অন্তর্ভুক্তিতা'র শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কল্যাণমুখী কাজে অকুতোভয়ে আগুয়ান হওয়ার প্রত্যয়ে 'নগর' নামক অ্যাপ তৈরির মাধ্যমে জনগণের স্বার্থে সদা সংযুক্ত থাকার উদ্যোগ নেন।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা 'বঙ্গবন্ধু'র ভীষণ ভক্ত ছিলেন তিনি। 'মেয়র' হিসেবে মাত্র দুটি বিষাদময় আগস্ট পেয়েছিলেন। প্রথম বারেই এই মহান পুরুষ আর বাংলার মুক্তি সংগ্রামের ওপর তিনি ও তাঁর সহধর্মিণীর নিজস্ব 'সংগ্রহে'র ছবির এক বিশেষায়িত প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেন। গণমানুষের অন্তর্ভুক্তিতার কথা মাথায় নিয়ে জাতীয় সংসদ প্লাজায় প্রদর্শনীর পরিকল্পনাটিও প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্যে বিশেষ অনুমোদন পায়। এত বিশাল আকারের বিরল ছবির মাধ্যমে 'বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ' নিয়ে সে ছিল এক অনন্য উপস্থাপন।
দ্বিতীয়বার অনেক ভাবনা শেষে টুঙ্গিপাড়ার 'বঙ্গবন্ধু সমাধি'র সঙ্গে ফি বছর ওইদিন স্মরিত 'বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্য শহীদদের সমাধিস্থল'কেও যথাযোগ্যভাবে উপস্থাপনের লক্ষ্যে বনানী কবরস্থানকে নিয়ে শুরু করেন আরেক উদ্যোগ। পরিস্থিতির কারণেই যা পরিণত হয় সময়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া এক দ্রুততায় বাস্তবায়ন কর্মযজ্ঞে। সেই সময় শরীরটা তাঁর গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অজ্ঞাত জটিলতায় আক্রান্ত, তথাপি এই কর্মবীর তখনও দৃঢ় সংকল্পের মত্ততায় কর্তব্যে স্থির। জরুরি পারিবারিক প্রয়োজনে লন্ডনে অবস্থান করেও বারবার তাগিদ দিচ্ছিলেন। বোধ করি ১১ আগস্ট ফোনালাপে সময়মতো ফিরতে না পারার বার্তাটিই আমার সঙ্গে তাঁর শেষ কথোপকথন। প্রাণদীপ্ত 'আনিস ভাই' তাঁর নেওয়া উদ্যোগটির প্রকৃত আদল জীবদ্দশায় আর দেখতে পারেননি। মাস তিনেক পর তাঁর অন্তিম শয়ানের মাধ্যমে প্রকল্প সমাপ্তির পর সেখানেই তাঁর প্রথম প্রবেশ।
কথিত 'খলিফা হারুনুর রশীদে'র মতোই দিন-রাত পরিশ্রমের মাধ্যমে বিলবোর্ড তথা দৃশ্য দূষণ থেকে মুক্তির উদ্যোগ কিংবা কড়াইল অথবা গুলশান মার্কেটে আগুন অভিঘাত প্রতিকারে অগ্রগামী হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের হৃদয়ে 'দিন বদলে'র বীজ বপন করছিলেন। তাই বাকপটু এই স্বপ্নবাজ মানুষটিকে নগর তথা দেশবাসী তাদের আস্থার প্রতীক হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল। আমৃত্যু এরই মর্যাদা দিতে ব্রতী ছিলেন আনিসুল হক। তাঁর মৃত্যুতে শোকবিহ্বল মানুষের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের এ গানটি তাই হৃদয়ে আলোড়িত হয়-
'নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে,
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে
হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।'
মন্তব্য করুন