দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল দুর্নীতি দমন ব্যুরো। এটিকে আরও স্বাধীন, শক্তিশালী ও কার্যকর করতে দুর্নীতি দমন ব্যুরো বিলুপ্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গঠন করা হয়। তারপরও দুদকের একজন সাবেক চেয়ারম্যান বিদায়কালে কমিশনকে নখ ও দন্তহীন বাঘ বলে অভিহিত করেছিলেন। এ মন্তব্যের পর আমরা আশা করেছিলাম, সংস্থাটি শক্তিশালী হবে। মামলার তদন্তে গতি আসবে। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের তদন্ত করতে গিয়ে সংস্থাটি আবারও প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে উচ্চ আদালত তাদের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ৩০ নভেম্বর সমকালে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, 'বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ৭৭ কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়ে মামলার তদন্ত তিন মাসের মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি তাদের এই সময়ের মধ্যে হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হলে দুদকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াত সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এ রায় দেন।' 

মামলায় বেসিক ব্যাংকের ২৭ কর্মকর্তা, ৮২ ব্যবসায়ী, ১১ বেসরকারি সার্ভেয়ারসহ মোট ১২০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আত্মসমর্পণ করেছেন একজন। মূল অভিযোগের তীর ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর দিকে হলেও অধরাই রয়ে গেছেন তিনি। ২০০৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। সদ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির নেতা-কর্মী-সমর্থককে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন জাতীয় পার্টির মধ্যম সারির নেতা শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। তাঁকে দেওয়া হয় বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ। 

সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক ও জনতা ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারিকে ছাড়িয়ে যায় বেসিক ব্যাংকের কেলেঙ্কারি। এই ব্যাংক থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়। বিভিন্ন সংস্থার সব ক'টি তদন্ত প্রতিবেদনেই বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির জন্য বাচ্চুকে দায়ী করা হলেও তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা এখনও খুঁজে পায়নি দুদক। 

জানা যায়, শেখ আবদুল হাই বাচ্চু আশির দশকে জাতীয় পার্টির একজন নেতা ছিলেন। ১৯৮৮ সালে চরম বিতর্কিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়ে বাগেরহাট-১ (চিতলমারী, মোল্লাহাট ও ফকিরহাট) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ রকম একজনকে ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়ায় তাঁর খুঁটির জোর নিয়ে নানা গুঞ্জন প্রচলিত। শোনা যায়, ক্ষমতার বলয়ভুক্ত বিশেষ ব্যক্তির আত্মীয় হওয়ার সুবাদে দুদকের জালে ধরা পড়ছে না কোনো কোনো রাঘববোয়াল। এ রকম গুঞ্জন চললেও দুদক বিশ্বরেকর্ড করার মতো রাঘববোয়াল ধরেছে বলে মন্তব্য করেছেন সংস্থাটির কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক। দুদকের ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ২১ নভেম্বর সংস্থাটির সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এমন মন্তব্য করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আপনারা সবসময় বলেন- দুদক কেবল চুনোপুঁটি ধরে। কিন্তু কতগুলো রাঘববোয়াল ধরেছে; আপনারা দেখেছেন কখনও?'

ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বরাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব) এমএ মতিন দুর্নীতিবাজদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে চুনোপুঁটি, রুই-কাতলা ও রাঘববোয়ালের প্রসঙ্গ টানেন। এর পর থেকে এ শব্দগুলোর ব্যবহার বেড়েছে। এবার দুদকের কমিশনারও তা ব্যবহার করলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অনেক রাঘববোয়াল ধরা হলেও বাচ্চুকে আইনের আওতায় আনা হলো না কেন? বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে এত সময় নিতে হচ্ছে কেন? 

অবশ্য সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে মতবিনিময়কালে এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ জানিয়েছেন, আইনি প্রক্রিয়ার কারণে অর্থ পাচারের তথ্য পেতে দেরি হয়। ট্রান্সপারেন্সির কথা বলে অনেক দেশ তথ্য দিয়ে সহায়তা করে না। সভায় অপর কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক খান জানিয়েছেন, 'মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত ২৭ ধরনের অপরাধের কেবলমাত্র একটি বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারে। অথচ অর্থ পাচারের যাবতীয় দায় দুদককে নিতে হয়। এটা অত্যন্ত পীড়াদায়ক।' পীড়া দূর করার জন্য দরকার হলে আইনের সংশোধন করা যেতে পারে। অন্য মন্ত্রণালয় বা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের দরকার হলে সে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সীমাবদ্ধতার প্রশ্ন তুলে তদন্তে দীর্ঘ সময় নেওয়ার পাশাপাশি প্রভাবশালীদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে নখ ও দন্তহীন বাঘ হয়েই থাকতে হবে দুদককে। 

ব্যাংকে রাখা গ্রাহকের আমানতের নিরাপত্তা নিয়ে নানা গুজব রটানো হচ্ছে। এর ফলে অনেক আমানতধারী আতঙ্কিত। এরই মধ্যে কেউ কেউ আমানত তুলে নিয়েছেন। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে গ্রাহকদের আশ্বস্ত করা হয়েছে- সব আমানত সুরক্ষিত। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ফয়সালা না হতেই সম্প্রতি তিনটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ঋণ প্রদানে যে অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। ব্যাংক হচ্ছে গ্রাহকদের আমানত সংরক্ষণের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। কতিপয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে দেশের আর্থিক খাতের ক্ষতি হতে দেওয়া যায় না। তাই এসব দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন জরুরি হয়ে পড়েছে। দলীয় ও পারিবারিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে দুর্নীতিবাজদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে না পারলে দুদকের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।