
১৮৮০ সালে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার অন্তর্গত পায়রাবন্দ গ্রামের সল্ফ্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে বেগম রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের। মা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। দুই ভাই, তিন বোনের মধ্যে বড় বোন করিমুন্নেসা ও বড় ভাই আবুল আসাদ মোহাম্মদ ইব্রাহীম সাবের বেগম রোকেয়ার জীবন আলোকিত করতে অপরিমেয় অবদান রাখেন। দ্বিতীয় ভাই আবু যায়গাম খলিল সাবের। ছোট বোন হোমায়রা তফাজ্জল হোসেন। দুই ভাই কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু অন্তঃপুরবাসিনী বোনদের স্কুলে যাওয়া বা ঘরের বাইরে গিয়ে লেখাপড়া করার কোনো সুযোগ ছিল না। সামন্তবাদী, রক্ষণশীল পরিবারে আরবি, উর্দু, ফার্সি ভাষার প্রচলন ছিল। কিন্তু বাংলা ভাষার চর্চা ছিল না। তাঁর বড় ভাই নিজে উদ্যোগী হয়ে রাতের অন্ধকারে মোমবাতি জ্বেলে বোনকে ইংরেজি পড়াতেন।
১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় বিহার প্রদেশের অন্তর্গত ভাগলপুরের অধিবাসী খান বাহাদুর সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে। বিদ্যানুরাগী, বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তির সঙ্গে সংসারজীবন শুরু হলে তাঁর লেখাপড়ার দ্বার প্রশস্ত হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ১৯০২ সালে আত্মপ্রকাশ ঘটে সাহিত্যিক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের।
১৯০২ সাল থেকে তাঁর লেখা কবিতা ও প্রবন্ধ 'নবপ্রভা', 'নবনূর', 'মহিলা', 'ভারতমহিলা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯০৭ সাল পর্যন্ত। ১৯০৫ সালে ইন্ডিয়ান লেডিস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় ইংরেজিতে লেখা "সুলতানা'স ড্রিম"। পরে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালে। এই গ্রন্থে কল্পনা, স্বপ্নে তিনি শান্তিপূর্ণ নারী রাজত্ব দেখিয়েছেন সমাজের সব মানুষকে। তাঁর সাহিত্য সাধনা নিছক সাহিত্য সৃষ্টি ছিল না। তিনি সাহিত্যের মধ্য দিয়ে নারীজীবন, দেশ ও সমাজ, ধর্ম বিষয়ে যা তুলে ধরেছেন; নিজের চিন্তাভাবনা ব্যক্ত করেছেন এবং তার সমাধানে সমাজে কাজ করার প্রয়াস পেয়েছেন। মাতৃভাষার প্রতি তাঁর ছিল গভীর টান। ভালো ইংরেজি জানার পরও একটি মাত্র গ্রন্থ তিনি ইংরেজিতে লিখেছেন। বাংলাভাষী মুসলমান ছাত্রীরা তাঁর স্কুলে অধিক সংখ্যায় ভর্তি হোক- এটি প্রতিনিয়ত চাইতেন। কিন্তু জীবদ্দশায় তাঁর সে আশা পূরণ হয়নি। অধিকাংশই ছিল উর্দুভাষী। তাঁর পরিবারে বাংলা ভাষার চর্চা না থাকলেও তিনি লেখার ক্ষেত্রে সাধারণ বাঙালি মুসলমান, হিন্দু ও ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ের বাংলা ভাষায় লিখতে মনস্থ করেন।
সাধারণ স্তরের মানুষের উন্নয়নের মাধ্যমে ঘটবে সবার উন্নতি- এ প্রত্যয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে তিনি দুঃসাহসিক মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন, 'এখানকার মুসলমানরা মাতৃহীন। কারণ তাদের মাতৃভাষা নেই।' 'স্ত্রী জাতির অবনতি' প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া প্রশ্ন উত্থাপন করে লিখলেন- 'আমরা সমাজেরই অর্ধঅঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কী রূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে- একই। তাঁহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই।'
রোকেয়া নারীদের সংগঠিত শক্তিতে বিশ্বাস করতেন বলেই ১৯১৬ সালে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কাজকর্ম করার অভিপ্রায়ে 'আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম' (নিখিল বঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেন। মানুষ হিসেবে নারীর সার্বিক উন্নয়ন ছিল তাঁর আরাধ্য। এসব কারণে তাঁকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারীবাদী বলা হয়।
৯ ডিসেম্বর রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের ৯১তম প্রয়াণ দিবস। প্রতি বছর এই তারিখে বাংলার নারীরা নিজেদের স্বার্থে, অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে, সমাজের কল্যাণে মহীয়সী এই নারীকে শ্রদ্ধাভরে, কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। চলমান আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষে (২৫ নভেম্বর-১০ ডিসেম্বর) পত্রপত্রিকা, গণমাধ্যমে যে নারী নির্যাতনের চিত্র এবং বিভিন্ন সংস্থাকৃত গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশিত হয়েছে, তার কোনোটিই সুখকর নয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বেগম রোকেয়া রচনাবলি পাঠ, তাঁর মৌলিক চিন্তা-চেতনার প্রাসঙ্গিকতা, কর্মের সুদূরপ্রসারী প্রভাব বর্তমান সময়েও সমান প্রযোজ্য বলে প্রতীয়মান। নারীমুক্তির পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
কাজী সুফিয়া আখতার: নারী অধিকার কর্মী ও গবেষক
১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় বিহার প্রদেশের অন্তর্গত ভাগলপুরের অধিবাসী খান বাহাদুর সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে। বিদ্যানুরাগী, বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তির সঙ্গে সংসারজীবন শুরু হলে তাঁর লেখাপড়ার দ্বার প্রশস্ত হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ১৯০২ সালে আত্মপ্রকাশ ঘটে সাহিত্যিক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের।
১৯০২ সাল থেকে তাঁর লেখা কবিতা ও প্রবন্ধ 'নবপ্রভা', 'নবনূর', 'মহিলা', 'ভারতমহিলা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯০৭ সাল পর্যন্ত। ১৯০৫ সালে ইন্ডিয়ান লেডিস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় ইংরেজিতে লেখা "সুলতানা'স ড্রিম"। পরে এটি বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯০৮ সালে। এই গ্রন্থে কল্পনা, স্বপ্নে তিনি শান্তিপূর্ণ নারী রাজত্ব দেখিয়েছেন সমাজের সব মানুষকে। তাঁর সাহিত্য সাধনা নিছক সাহিত্য সৃষ্টি ছিল না। তিনি সাহিত্যের মধ্য দিয়ে নারীজীবন, দেশ ও সমাজ, ধর্ম বিষয়ে যা তুলে ধরেছেন; নিজের চিন্তাভাবনা ব্যক্ত করেছেন এবং তার সমাধানে সমাজে কাজ করার প্রয়াস পেয়েছেন। মাতৃভাষার প্রতি তাঁর ছিল গভীর টান। ভালো ইংরেজি জানার পরও একটি মাত্র গ্রন্থ তিনি ইংরেজিতে লিখেছেন। বাংলাভাষী মুসলমান ছাত্রীরা তাঁর স্কুলে অধিক সংখ্যায় ভর্তি হোক- এটি প্রতিনিয়ত চাইতেন। কিন্তু জীবদ্দশায় তাঁর সে আশা পূরণ হয়নি। অধিকাংশই ছিল উর্দুভাষী। তাঁর পরিবারে বাংলা ভাষার চর্চা না থাকলেও তিনি লেখার ক্ষেত্রে সাধারণ বাঙালি মুসলমান, হিন্দু ও ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ের বাংলা ভাষায় লিখতে মনস্থ করেন।
সাধারণ স্তরের মানুষের উন্নয়নের মাধ্যমে ঘটবে সবার উন্নতি- এ প্রত্যয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৩০ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সম্মেলনে তিনি দুঃসাহসিক মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন, 'এখানকার মুসলমানরা মাতৃহীন। কারণ তাদের মাতৃভাষা নেই।' 'স্ত্রী জাতির অবনতি' প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া প্রশ্ন উত্থাপন করে লিখলেন- 'আমরা সমাজেরই অর্ধঅঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কী রূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে- একই। তাঁহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই।'
রোকেয়া নারীদের সংগঠিত শক্তিতে বিশ্বাস করতেন বলেই ১৯১৬ সালে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কাজকর্ম করার অভিপ্রায়ে 'আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম' (নিখিল বঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতি) প্রতিষ্ঠা করেন। মানুষ হিসেবে নারীর সার্বিক উন্নয়ন ছিল তাঁর আরাধ্য। এসব কারণে তাঁকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারীবাদী বলা হয়।
৯ ডিসেম্বর রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের ৯১তম প্রয়াণ দিবস। প্রতি বছর এই তারিখে বাংলার নারীরা নিজেদের স্বার্থে, অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে, সমাজের কল্যাণে মহীয়সী এই নারীকে শ্রদ্ধাভরে, কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। চলমান আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষে (২৫ নভেম্বর-১০ ডিসেম্বর) পত্রপত্রিকা, গণমাধ্যমে যে নারী নির্যাতনের চিত্র এবং বিভিন্ন সংস্থাকৃত গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশিত হয়েছে, তার কোনোটিই সুখকর নয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে বেগম রোকেয়া রচনাবলি পাঠ, তাঁর মৌলিক চিন্তা-চেতনার প্রাসঙ্গিকতা, কর্মের সুদূরপ্রসারী প্রভাব বর্তমান সময়েও সমান প্রযোজ্য বলে প্রতীয়মান। নারীমুক্তির পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
কাজী সুফিয়া আখতার: নারী অধিকার কর্মী ও গবেষক
মন্তব্য করুন