
ওয়াজ মানে নসিহত, বক্তৃতা, উপদেশ বা ভাষণ। শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহ প্রদত্ত নির্দেশনার আলোকে ইসলামের দিকে মানুষকে আহ্বান করে যে বক্তৃতা বা নসিহত করা হয়, তাই ওয়াজ হিসেবে পরিগণিত। ইসলামের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ওয়াজ বা ভাষণ হলো বিদায় হজে সোয়া লাখ সাহাবায়ে কেরামের বিশাল জনসমুদ্রে প্রদত্ত মহানবীর (সা.) ঐতিহাসিক ভাষণ, যা মানব জাতির জন্য মুক্তি ও সফলতার এক অনবদ্য প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। শুধু বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণই নয়, রাসুল (সা.)-এর যে কোনো কথা বা বক্তব্যেই শ্রোতা-দর্শকরা তন্ময়াপ্লুত হয়ে যেত। তাঁর কথা বা উপদেশমালায় ছিল নজিরবিহীন প্রভাব, যা সবাইকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করত। রাসুলের (সা.) বাণীতেই আমরা জানতে পারি- 'কোনো কোনো বক্তৃতা নিশ্চয়ই জাদু তথা জাদুর মতো মানুষকে প্রভাবিত করে। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই এই ওয়াজের রীতি প্রচলিত এবং আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক পরিমণ্ডলে উল্লেখযোগ্য মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণে এখনও তা বলবৎ।
হেকমত বা প্রজ্ঞার পূর্বশর্ত যথার্থ ও পর্যাপ্ত জ্ঞান আর সদুপদেশ প্রদান বা সুন্দরতম নসিহত দানের জন্য জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সমন্বিত নিয়ামত আবশ্যক। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের দেশে বর্তমানে যাঁরা ধর্মের বাণী প্রচারে মশগুল; ওয়াজ-নসিহত করছেন; ইসলামের নানা বিষয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন, অধিকাংশেরই সংশ্নিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানের দৈন্য, প্রজ্ঞার অপ্রতুলতা ও সর্বোত্তম পন্থায় সদুপদেশ প্রদানের যোগ্যতায় যথেষ্ট ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। যে কারণে আজগুবি কথাবার্তা, নানা ধরনের উদ্ভট ও কাল্পনিক কিস্সা-কাহিনি, রঙ্গ-রসাত্মক আলোচনা, ইসলামের নানা বিষয়ে অপব্যাখ্যা, মন গড়া কথাবার্তা, অবাস্তব ঘটনাবলির বিবরণ, দুর্বল ও অনেক ক্ষেত্রে জাল সনদ সম্পৃক্ত হাদিস-বাণীর জোরালো উল্লেখ। এর মাধ্যমে মূলত ইসলামেরই বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন রূপরেখার অপমৃত্যু ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে যাঁরা উপর্যুক্ত কায়দায় ওয়াজ-নসিহত করে ধর্মের প্রচার বা খেদমত করছেন বলে পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন; তাঁরা আসলে ওয়াজ নয়, আওয়াজ করছেন। তাঁদের এসব ওয়াজে ফায়দাহীন আওয়াজই শুধু হচ্ছে।
ওয়াজ আমাদের দেশীয় মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত। তাই পরিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও নৈতিক মূল্যবোধের অনবদ্য শিক্ষাকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং তা যথাযথ প্রক্রিয়ায় উপস্থাপন করাই সময়ের দাবি। প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে যুবক শ্রেণি এমনকি শিশু-কিশোররাও ওয়াজের মাহফিলে উপস্থিত হয়। সুতরাং ধর্মীয় বক্তাদের উচিত সব শ্রেণির দর্শক-শ্রোতার চাহিদা এবং এ থেকে তারা কী শিখবে- সেসব বিষয় খেয়াল রাখা। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা প্রচারযন্ত্রের বদৌলতে আমরা অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করছি বেশ কিছু বিতর্কিত বক্তার নানা মতলবি কর্মকাণ্ড; ওয়াজের পবিত্র মাহফিলে তাঁদের অঙ্গভঙ্গি, কথাবার্তা, সুরের ঢং ও চিৎকারের অবস্থা দেখে অনেককেই সুস্থ ও স্বাভাবিক মনে হয় না। আলেম, ওয়ায়েজ বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব দূরের কথা, এমনকি অতি সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও এ ধরনের বাক্য ও আচার-আচরণ প্রত্যাশিত নয়। ওয়াজের নামে কৌতুক, চলচ্চিত্রের বিভিন্ন গানের সুরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ সংগীতের বাহারি পরিবেশন, ধর্মীয় ও জাগতিক বিষয়ে বিতর্কিত বক্তব্য, নারী বিদ্বেষী আলোচনা, দেশের সংবিধান ও মূলনীতিবিরোধী প্রোপাগান্ডা, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার অপপ্রয়াস চালানো, যে কাউকে কাফের বলে ফতোয়া প্রদানসহ বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্যকে আরও জটিল করে উস্কে দেওয়া- অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসবই চলছে ওয়াজের নামে।
বঙ্গীয় অঞ্চলে ইসলাম প্রবেশের পর থেকেই নিঃস্বার্থ ও নির্লোভ চিত্তের সুফিরা আপামর জনসাধারণকে তাঁদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে দ্বীন-ধর্ম আর পার্থিব-অপার্থিব বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা বা পরামর্শ প্রদান করতেন। সুফি-কুতুবদের কথাবার্তা ও আচার-আচরণে উদার, নৈতিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতা ফুটে উঠত। ধর্ম প্রচারের ব্রত নিয়ে তাঁরা কাজ করেছেন শুধু মহান প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। চুক্তি করে টাকা নেওয়া, দাওয়াত পেলে আগন্তুককে বেকায়দায় ফেলে কৌশলে মতলব হাসিল করা এবং ধর্মীয় লেবাস ও জ্ঞান-গরিমাকে কাজে লাগিয়ে অর্থ উপার্জনের কোনো ইতিহাস সুফিদের দর্শন ও বিশ্বাসে ছিল না। সে জন্যই লোকেরা তাঁদের কথা শুনেছে; তাঁদের ভক্তি-শ্রদ্ধা করেছে এবং তাঁদের ইন্তেকালের সময় থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিক্রান্ত হলেও এখনও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র জনসাধারণের হৃদয়ের গভীর মণিকোঠায় তাঁদের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা ও ভক্তি অক্ষুণ্ণ রয়েছে। বর্তমানের অধিকাংশ সেই ঐতিহ্যের বিপরীতে প্রবহমান বিধায় তাঁদের ওয়াজ শুধু নিষ্ম্ফল আওয়াজে পরিণত হয়েছে; যাতে ইসলামের কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই বেশি বয়ে আনছে।
ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন: অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
হেকমত বা প্রজ্ঞার পূর্বশর্ত যথার্থ ও পর্যাপ্ত জ্ঞান আর সদুপদেশ প্রদান বা সুন্দরতম নসিহত দানের জন্য জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সমন্বিত নিয়ামত আবশ্যক। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের দেশে বর্তমানে যাঁরা ধর্মের বাণী প্রচারে মশগুল; ওয়াজ-নসিহত করছেন; ইসলামের নানা বিষয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন, অধিকাংশেরই সংশ্নিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানের দৈন্য, প্রজ্ঞার অপ্রতুলতা ও সর্বোত্তম পন্থায় সদুপদেশ প্রদানের যোগ্যতায় যথেষ্ট ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। যে কারণে আজগুবি কথাবার্তা, নানা ধরনের উদ্ভট ও কাল্পনিক কিস্সা-কাহিনি, রঙ্গ-রসাত্মক আলোচনা, ইসলামের নানা বিষয়ে অপব্যাখ্যা, মন গড়া কথাবার্তা, অবাস্তব ঘটনাবলির বিবরণ, দুর্বল ও অনেক ক্ষেত্রে জাল সনদ সম্পৃক্ত হাদিস-বাণীর জোরালো উল্লেখ। এর মাধ্যমে মূলত ইসলামেরই বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন রূপরেখার অপমৃত্যু ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে যাঁরা উপর্যুক্ত কায়দায় ওয়াজ-নসিহত করে ধর্মের প্রচার বা খেদমত করছেন বলে পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন; তাঁরা আসলে ওয়াজ নয়, আওয়াজ করছেন। তাঁদের এসব ওয়াজে ফায়দাহীন আওয়াজই শুধু হচ্ছে।
ওয়াজ আমাদের দেশীয় মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত। তাই পরিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ও নৈতিক মূল্যবোধের অনবদ্য শিক্ষাকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং তা যথাযথ প্রক্রিয়ায় উপস্থাপন করাই সময়ের দাবি। প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে যুবক শ্রেণি এমনকি শিশু-কিশোররাও ওয়াজের মাহফিলে উপস্থিত হয়। সুতরাং ধর্মীয় বক্তাদের উচিত সব শ্রেণির দর্শক-শ্রোতার চাহিদা এবং এ থেকে তারা কী শিখবে- সেসব বিষয় খেয়াল রাখা। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা প্রচারযন্ত্রের বদৌলতে আমরা অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করছি বেশ কিছু বিতর্কিত বক্তার নানা মতলবি কর্মকাণ্ড; ওয়াজের পবিত্র মাহফিলে তাঁদের অঙ্গভঙ্গি, কথাবার্তা, সুরের ঢং ও চিৎকারের অবস্থা দেখে অনেককেই সুস্থ ও স্বাভাবিক মনে হয় না। আলেম, ওয়ায়েজ বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব দূরের কথা, এমনকি অতি সাধারণ মানুষের কাছ থেকেও এ ধরনের বাক্য ও আচার-আচরণ প্রত্যাশিত নয়। ওয়াজের নামে কৌতুক, চলচ্চিত্রের বিভিন্ন গানের সুরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ সংগীতের বাহারি পরিবেশন, ধর্মীয় ও জাগতিক বিষয়ে বিতর্কিত বক্তব্য, নারী বিদ্বেষী আলোচনা, দেশের সংবিধান ও মূলনীতিবিরোধী প্রোপাগান্ডা, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার অপপ্রয়াস চালানো, যে কাউকে কাফের বলে ফতোয়া প্রদানসহ বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্যকে আরও জটিল করে উস্কে দেওয়া- অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসবই চলছে ওয়াজের নামে।
বঙ্গীয় অঞ্চলে ইসলাম প্রবেশের পর থেকেই নিঃস্বার্থ ও নির্লোভ চিত্তের সুফিরা আপামর জনসাধারণকে তাঁদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে দ্বীন-ধর্ম আর পার্থিব-অপার্থিব বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা বা পরামর্শ প্রদান করতেন। সুফি-কুতুবদের কথাবার্তা ও আচার-আচরণে উদার, নৈতিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতা ফুটে উঠত। ধর্ম প্রচারের ব্রত নিয়ে তাঁরা কাজ করেছেন শুধু মহান প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। চুক্তি করে টাকা নেওয়া, দাওয়াত পেলে আগন্তুককে বেকায়দায় ফেলে কৌশলে মতলব হাসিল করা এবং ধর্মীয় লেবাস ও জ্ঞান-গরিমাকে কাজে লাগিয়ে অর্থ উপার্জনের কোনো ইতিহাস সুফিদের দর্শন ও বিশ্বাসে ছিল না। সে জন্যই লোকেরা তাঁদের কথা শুনেছে; তাঁদের ভক্তি-শ্রদ্ধা করেছে এবং তাঁদের ইন্তেকালের সময় থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিক্রান্ত হলেও এখনও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র জনসাধারণের হৃদয়ের গভীর মণিকোঠায় তাঁদের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা ও ভক্তি অক্ষুণ্ণ রয়েছে। বর্তমানের অধিকাংশ সেই ঐতিহ্যের বিপরীতে প্রবহমান বিধায় তাঁদের ওয়াজ শুধু নিষ্ম্ফল আওয়াজে পরিণত হয়েছে; যাতে ইসলামের কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই বেশি বয়ে আনছে।
ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন: অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিষয় : ইসলাম ও সমাজ মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন
মন্তব্য করুন