বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বিভাগীয় সমাবেশের মধ্যে ৯টি ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। নবম সমাবেশটি ছিল গত ৩ ডিসেম্বর, রাজশাহীতে। বিএনপি আহূত এসব সমাবেশে মানুষের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয় এবং আলোচিত। সমাবেশে মানুষের অংশগ্রহণে বাধা ছিল প্রকট। গায়েবি মামলা, নেতাদের বাড়ি বাড়ি পুলিশের তল্লাশি, গ্রেপ্তার, হুলিয়া, সরকারি দলের নেতাকর্মীর হুমকি, সমাবেশবিরোধী প্রচারণার পাশাপাশি ছিল পরিবহন ধর্মঘট। এত বাধা, ভয় ও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে খোলা জায়গায় ৯৬ ঘণ্টা কাটিয়ে জনসভায় যোগ দিয়েছে মানুষ। শেষ সভাটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আগামীকাল ১০ ডিসেম্বর ঢাকায়। গোলটি বাধে ঢাকার ভেন্যু নিয়ে। বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে চায়। পুলিশ সেখানে সমাবেশ করতে দিতে নারাজ। দু'পক্ষের আলাপ-আলোচনার মাঝে হঠাৎ ৭ ডিসেম্বর দুপুরের পরপর বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে ঘটে লঙ্কাকাণ্ড। ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। আহতদের আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ, পথচারী, দলীয় কর্মী ও নেতারা দলীয় অফিসে নিরাপদ আশ্রয় নেন। পুলিশ সেখানেও হানা দেয়। টিয়ার গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট, গুলি- সবকিছুই ব্যবহূত হয়।
পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয় সরকারদলীয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। পুলিশের পাশে থেকে তাদেরকেও বিএনপি নেতাকর্মী লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। সংঘর্ষের পর নয়াপল্টনে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখান থেকে দলটির কেন্দ্রীয় নেতা আমান উল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, রুহুল কবির রিজভী, খায়রুল কবীর খোকন, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, ছাত্রদলের সাবেক নেতা আবদুল কাদের ভূঁইয়াসহ কয়েকশ নেতাকর্মীকে আটক করে পুলিশ।
বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে রাত সাড়ে ৭টা পর্যন্ত চলে আটক অভিযান। পুলিশ কার্যালয়ের ভেতরে তল্লাশি চালায়, যা শেষ হয় রাত ৯টায়। এর পর ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ নয়াপল্টনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, এই অভিযানে ৩০০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। এর সবই দেশের মানুষ টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি দেখেছে। কাজেই এগুলো নতুন করে আর বর্ণনার প্রয়োজন নেই।
নয়াপল্টনে বিএনপির দলীয় অফিসে এর আগেও পুলিশি তল্লাশির নামে হামলা, নেতাদের গ্রেপ্তার এবং কর্মীদের বেধড়ক মারধর আমরা দেখেছি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়। ১৫ বছর ধরে বিরোধী মত দমনে সরকারের নির্দেশে পুলিশকে মরিয়া ও মারমুখী অবস্থা দেখে আমরা অভ্যস্ত। এ আর নতুন কী! কিন্তু এর শেষ কোথায়?
ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিলাম। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্ব্বর স্বৈরাচারী এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার আর মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করলেও আজও গণতন্ত্র অধরা। সামাজিক ন্যায়বিচার আর মানবিক মর্যাদা তো বহু দূরে। এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ ভোটের যে অধিকার ফিরে পেয়েছিল, তা এক-এগারো সরকারের পরবর্তীকালে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তি, দল, সরকার আর রাষ্ট্র এখন এ দেশে মিলেমিশে একাকার। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর এ দেশের মানুষের নির্বাচনের যে অভিজ্ঞতা, তা ভোলার নয়। অথচ গণতন্ত্রের জন্য এ দেশের মানুষের চরম আত্মত্যাগ রয়েছে।
জাতিসংঘের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র অনুযায়ী মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশ করার স্বাধীনতা, রাজনৈতিক বিশ্বাসের স্বাধীনতা মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে তার নাগরিকের এসব অধিকার সুরক্ষার জন্য দায়বদ্ধ। আমাদের সংবিধানেও সমাবেশ করা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। তবু বারবার এ দেশের মানুষ ভারসাম্যপূর্ণ, পরিশীলিত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা থেকে থেকেছে যোজন যোজন দূরে। সড়কে সমাবেশ করতে না দেওয়ার যে যুক্তি এখন দেওয়া হচ্ছে, সেটি সবার জন্য সমভাবে প্রয়োগ হয় না কেন? গত নভেম্বরে রাজধানীর মধ্য বাড্ডা এলাকায় প্রগতি সরণিতে এবং উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ সড়কে যান চলাচল বন্ধ রেখে দুটি বড় সমাবেশ করেছিল আওয়ামী লীগ। গত ৫ ও ২০ নভেম্বর রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ দুটি সড়কে ওই দুই সমাবেশের কারণে ব্যাপক জনদুর্ভোগ হলেও ঢাকা মহানগর পুলিশ তখন নীরব ছিল। এমনকি ওই দুটি সমাবেশ রাস্তার পরিবর্তে খোলা মাঠে করা বা সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষ থেকে কঠোর কোনো শর্ত দেওয়ার কথাও শোনা যায়নি। ফলে জনদুর্ভোগ হবে- এই বিবেচনার চেয়েও নয়াপল্টনে অন্য কিছু (!) বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মানুষ মনে করছে। গত ১৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০ ও ২৭ অক্টোবর এবং ২, ৭, ৮, ১০, ১৭, ১৮ ও ৩০ নভেম্বর নয়াপল্টনে মোট ১১টি সমাবেশ করেছে বিএনপি। এই সমাবেশগুলো সুশৃঙ্খল ছিল। জনসমাগমও ছিল ব্যাপক। তখন জনদুর্ভোগের কথা না উঠলেও এখন কেন উঠছে- তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পল্টন খুবই পরিচিত নাম। পল্টন ময়দানের রাজনৈতিক স্মৃতি এখনও অনেক মানুষের মনে জ্বলজ্বল। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে রাজনৈতিক সভা বন্ধ করতে স্থায়ী ডিভাইডার নির্মাণ ও বৃক্ষ রোপণ করা হয়েছে। আমাদের দেশে প্রায় সব রাজনৈতিক দল সড়ক ও মাঠে সমাবেশ করে অভ্যস্ত। আমজনতা তা দেখে ও সয়েও অভ্যস্ত। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে আমরা এখনও যদি স্বাধীনভাবে সমাবেশ করার অধিকার না পাই; পছন্দমতো যদি ভোট দিতে না পারি; দেশের ব্যাংকগুলো যদি ক্রমাগত খালি হতে থাকে; বিচার যদি প্রহসনে পরিণত হয়; সংসদ যদি সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বমূলক না হয়, তবে কেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ? আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদদের আমরা কী জবাব দেব? বিএনপির চলমান আন্দোলনের ন্যায্যতা আছে। আছে গণসম্পৃক্ততা। পুরো জাতি আজ রাজনৈতিক অধিকারহারা। দ্রব্যমূল্য সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মানুষ তার প্রয়োজনমতো আমিষ খেতে পারছে না। এ কথাগুলো বলতেই বিএনপি সমাবেশ করছে। সরকার জনবান্ধব ও গণতান্ত্রিক হলে এসব কথায় তাদের সায় থাকারই কথা। কিন্তু আমরা তা দেখছি না।
জাহেদুল আলম হিটো: মানবাধিকার কর্মী