
সংকটকালেই কৃষির গুরুত্ব বেশি অনুভব করা যায়। কভিডকালে বিশ্ব যখন থমকে দাঁড়িয়েছিল, তখনও বাংলাদেশের কৃষি খাত বসে থাকেনি। কৃষকরা মোটেও ভয় পায়নি। দিনরাত তারা কৃষি উৎপাদনে ব্যস্ত ছিল। পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এবং ব্যক্তি ও বেসরকারি খাতের মাঠকর্মীরা সমান তালে কৃষিচর্চায় নিবেদিত ছিল। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে বোরো মৌসুমে প্রশাসন, ব্যক্তি খাত, রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত কর্মযজ্ঞ দেখে মনে হয়েছে, এ দেশের মানুষ কৃষির গুরুত্ব ঠিকই বোঝে। ওই সংকটকালে যারা শহর থেকে গ্রামে চলে গেছে, তাদের জন্যও গ্রামীণ অর্থনীতির দরজা খোলা ছিল। অনেক শিক্ষিত তরুণ-তরুণী তখন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে নয়া কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে মেধা ও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছে। এখনও তাদের অনেকে কৃষির আধুনিকায়ন, যান্ত্রিকীকরণ ও ই-বাণিজ্য প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে।
কভিড সংকট থেকে ঘুরে না দাঁড়াতেই শুরু হলো ইউক্রেন যুদ্ধ। এ কারণে কৃষিপণ্যের সরবরাহ চেইনে বড় বিপর্যয় দেখা দেয়। সেই সঙ্গে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানিজনিত কৃষিপণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। রিজার্ভ ক্ষয়ে এলেও কৃষিপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকার বাজেটের বড় অংশ খরচ করতে দ্বিধা করেনি। সেই সঙ্গে কৃষক, ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক খাতও এগিয়ে এসেছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার, কৃষক ও কৃষি সম্পর্কিত অংশীজন যে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছেন, তাই বা অস্বীকার করি কীভাবে? সংকটকালে কৃষিই যে আমাদের রক্ষাকবচ- সেই কথাটি নিরন্তর প্রমাণ করে চলেছে সবাই মিলে।
কথাগুলো হৃদয় দিয়ে অনুভব করেতে পেরেছি সম্প্রতি কোটালীপাড়ায় বাপার্ডে (বঙ্গবন্ধু দারিদ্র্য বিমোচন ও পল্লী উন্নয়ন একাডেমি) অনুষ্ঠিত 'কৃষি উৎসব' দেখে। বিভিন্ন ব্যাংক ও কোম্পানির সহযোগিতায় 'নিউ স্টার ইনোভেশন' এ উৎসবের আয়োজন করেছিল ২৬-২৮ নভেম্বর। দেশের আলোকিতজন সেখানে যোগ দিয়েছিলেন গ্রামীণ মানুষকে প্রেরণা দিতে। কৃষি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো নিয়ে এসেছিল বিস্ময়কর যন্ত্রপাতি। আর ব্যাংকগুলো কৃষিঋণ সম্পর্কে মানুষকে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করেছে। উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল ব্র্যাক ব্যাংক। এ ছাড়া পৃষ্ঠপোষকতা করেছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও মেটাল গ্রুপ। কৌশলগত অংশীদার ছিল ইউনিডো, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর, গেইন বাংলাদেশ, ইন্টারন্যাশনাল পটেটো সেন্টার এবং সিসিডিবি। কৃষক ও বিভিন্ন অংশীজনের নিবিড় আলোচনা আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনেছি ও অনেক শিখেছি।
আলাপের সারকথা ছিল, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে কলকারখানা ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের কারণে কৃষিজমির ওপর চাপ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে কৃষিজমির পরিমাণের পাশাপাশি উর্বরতাও কমছে। আগামী দিনে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণে উচ্চফলনশীল জাত ও আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ।
কৃষিতে যন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে খরচ কমিয়ে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। মেটাল গ্রুপ কৃষি উৎসবে প্রদর্শন করেছে কম্বাইন্ড হারভেস্টার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার ও ট্র্যাক্টর। কম্বাইন্ড হারভেস্টারের মাধ্যমে ধান কাটা, মাড়াই ও ঝাড়াই করা যায়। এই যন্ত্র দিয়ে দানা জাতীয় শস্য যেমন ধান ও গম খুব দ্রুত সরাসরি মাঠ থেকে সংগ্রহ করা যায়। এর ফলে শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ফেলা সম্ভব। সরকার এই যন্ত্রের ওপর ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ ভর্তুকি দিয়ে থাকে।
মেটাল বলেছে, কৃষি যন্ত্রপাতি তারা কৃষকদের কিস্তিতে দিয়ে থাকে। কিন্তু কিস্তি আদায় তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। ফলে এই প্রক্রিয়ায় ব্যাংকগুলো অংশ নিলে বিষয়টি সহজ হবে। কৃষককেও বেশি সেবাদান সম্ভব হবে। এছাড়া ব্যাংক সহজ ঋণ দিলে কৃষি উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি সম্ভব।
বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি খাতের ওপর নির্ভরশীল। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষি খাতের অবদান ১১ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে এই খাতে কর্মসংস্থান ৪০ শতাংশের বেশি। কৃষি খাতের অগ্রগতিতে ব্যাংকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী কৃষিঋণের প্রধান তিনটি খাতে (শস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ) ঋণ বিতরণে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শস্য খাতে মোট লক্ষ্যমাত্রার নূ্যনতম ৬০ শতাংশ, মৎস্য খাতে লক্ষ্যমাত্রার নূ্যনতম ১০ শতাংশ এবং প্রাণিসম্পদ খাতে লক্ষ্যমাত্রার নূ্যনতম ১০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে হবে। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ঋণ বিতরণে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
কৃষি উৎসবে ব্যাংকগুলো সরাসরি কৃষকের সঙ্গে আলোচনায় ও কৃষি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে। ব্র্যাক ব্যাংক সেখানে উন্মুক্ত করেছে 'সুফলা' নামে নতুন ঋণ প্যাকেজ। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকও কৃষকদের ঋণ দিয়েছে। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক আগ্রহ দেখিয়েছে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখার। অনুষ্ঠানে আগত কৃষকদের জন্য স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সৌজন্যে বিনামূল্যে ডাক্তারের পরামর্শ ও ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া কৃষি উৎপাদনের জন্য খুবই ক্ষতিকর। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা ও লোনা পানির অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত জোরালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে। উৎসবে অংশ নিয়ে কৃষকরা, বিশেষত নারী প্রতিনিধিরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অভিজ্ঞতার কথা বলেছে অকপটে। এখন তাদের দরকার জলবায়ুসহিষুষ্ণ কৃষি প্রযুক্তি ও ফসলের জাত। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এ নিয়ে কাজ করছে। আবার কৃষি কার্যক্রম পরিচালনায় দরকার অর্থ। তাই সহজে অর্থপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা না গেলে কৃষকের পক্ষে কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন সম্ভব নয়।
আলাপে আরও বের হয়ে এলো যে, খাদ্যের উৎপাদন বাড়লেও সবার জন্য পুষ্টি নিশ্চিত করা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্য অর্জনেও পুষ্টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারের নীতি-সহায়তা ছাড়াও ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে পুষ্টি সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যাংকের অংশগ্রহণ একান্তভাবে কাম্য।
বিভিন্ন অংশীজনের কথা শুনে এবং আলোচনায় অংশ নিয়ে আমি একাধিক অধিবেশনে যা বলেছি, সেসবের নির্যাস হলো- ব্যাংক নিয়ে কৃষকদের ভয় দূর করতে ব্যাংকারদের এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, কৃষকরা আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। দুর্যোগের সময় তাদের অবদানই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। তাই সব সময় আমাদের তাদের পাশে থাকতে হবে, যেন তারা নিজেদের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারে। ব্যাংকগুলোকে সনাতনী ব্যাংকিং ছেড়ে উদ্ভাবনী ব্যাংকিং করতে হবে, যাতে কৃষকের স্বার্থ রক্ষা হয়। এ ছাড়া কৃষিতে সবুজ প্রযুক্তি বিস্তারে আরও অর্থায়ন করতে হবে, যাতে কার্বন নির্গমন প্রশমিত করা যায়।
নিঃসন্দেহে কৃষি উৎসব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের নতুন দ্বার উন্মুক্ত করেছে। এর মাধ্যমে কৃষকরা সুযোগ পাচ্ছে সরাসরি তাদের কথা বলার। নীতিনির্ধারক, গবেষক, ব্যাংকার ও বিনিয়োগকারীরা সুযোগ পাচ্ছেন পল্লী এলাকার প্রকৃত চিত্র অনুধাবন করার। এমন উৎসব দেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়ূক।
ড. আতিউর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সম্মানীয় অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
dratiur@gmail.com
মন্তব্য করুন