বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করিয়া মাসাধিককাল ধরিয়া রাজনীতিতে যে উত্তাপ ছড়াইয়াছে; দুঃখজনভাবে তাহার দুই দিন পূর্বেই বুধবার দলটির কার্যালয়ের সম্মুখে নয়াপল্টনে সংঘর্ষের ঘটনায় একজন প্রাণ হারাইয়াছেন। বৃহস্পতিবার সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, পুলিশের সহিত দলটির নেতাকর্মীর দফায় দফায় সংঘর্ষে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়-সংযুক্ত অঞ্চল রণক্ষেত্রে রূপ পরিগ্রহ করে। উক্ত সংঘর্ষে তিনটা মামলায় তিন সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা এবং বিএনপির প্রায় পাঁচ সহস্র নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি বাড়াবাড়ি এবং শান্তিপূর্ণ অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত।

আমরা জানি, সর্বশেষ সমাবেশস্থল নির্ধারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপির মধ্যে বিরোধ চলিতেছিল। বিএনপি নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সম্মুখে সমাবেশ অনুষ্ঠান বিষয়ে জোর প্রদান করিলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তাহা আয়োজনের প্রস্তাব দেয়। আমরা ভাবিয়াছিলাম, উভয় পক্ষের মধ্যে এই লইয়া রাজনৈতিক সমঝোতা হইবে। কিন্তু বুধবারের ঘটনায় আমাদের সে প্রত্যাশার গুড়ে বালি পড়িয়াছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেহেতু ইতোপূর্বে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সম্মুখে সমাবেশ করিয়াছিল; বিএনপিকেও তদ্রূপ নয়াপল্টনে সমাবেশ করিবার অনুমতি প্রদান করিলে বিশেষ ক্ষতি-বৃদ্ধি হইত না। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ হইতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করিবার প্রস্তাবও বিএনপি বিবেচনা করিতে পারিত। তবে ইহা সত্য, বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি যে সকল সমাবেশ করিয়াছিল, তাহা নির্বিঘ্ন ছিল না। প্রায় প্রতিটির ক্ষেত্রে সমাবেশের পূর্ব হইতেই সংশ্নিষ্ট শহরে পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করা হইয়াছে। এতদ্‌সত্ত্বেও বিএনপির কর্মী-সমর্থক সকল বাধা অপসারণপূর্বক দূর-দূরান্ত হইতে সমাবেশে উপস্থিত হইয়া কর্মসূচি সফল করিয়াছিল।

ঢাকার সমাবেশ লইয়া একদিকে বিএনপি নেতারা পূর্ব হইতেই যে রূপ প্রচার করিতেছিলেন, তাহাও গ্রহণযোগ্যতার মাত্রার মধ্যে ছিল না। ক্ষমতাসীনরা বিষয়টা স্বাভাবিক রূপে গ্রহণ করেন নাই বলিয়াই ইতোমধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়াছে। বিশেষ করিয়া পুলিশ ঢাকাসহ সমগ্র দেশে যে রূপ বিশেষ অভিযান শুরু করিয়াছে, তাহাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ হইতে চলমানকার্যের অংশ বলা হইলেও উহা যে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করিয়াই; তাহা অনুধাবন করা কঠিন নহে। আমরা দেখিয়াছি, এই সকল অভিযানের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিরোধী দলের নেতাকর্মীকেই হয়রানি করা হইয়াছে। তাহাদের অনেকে আতঙ্কিত হইয়া যেই হারে গৃহত্যাগী হইয়াছে, তাহাও উত্তম দৃষ্টান্ত নহে। বস্তুত ঐ নেতাদিগের পুরাতন মামলা সচল করা কিংবা অনেকের বিরুদ্ধে অকস্মাৎ যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হইয়াছে, তাহা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত- এমন অনুমান অমূলক নহে। বিস্ময়কর হইলেও সত্য, ইতোমধ্যে এক বিএনপি নেতা ও তাহার কর্মীদের উপর ছাত্রলীগ হামলা করিয়াছে। এমনকি ১০ ডিসেম্বর আহূত সমাবেশের দিন বিভিন্ন এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী 'পাহারায়' থাকিবেন বলিয়া যে হুঁশিয়ারি দেওয়া হইয়াছে, তাহাও গ্রহণযোগ্য নহে।

স্মরণ রাখিতে হইবে, সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠান বিরোধীদের সংাবিধানিক অধিকার। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে কোনো দল অন্য দলের উপর হামলা চালাইতে পারে না। ক্ষমতাসীনদের কর্তব্য যথা বিরোধীদের অধিকার নিশ্চিতকরণ; তথায় রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যহার করিয়া দমন-পীড়ন পরিচালন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও স্থিতিশীল রাজনীতির পরিপন্থি বলিয়া আমরা মনে করি। বুধবার সংঘাতের পর আমরা দেখিয়াছি, ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি এক বিবৃতিতে মতপ্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার নিশ্চিতের তাগিদ দিয়াছেন। অপরদিকে ঢাকায় রাজনৈতিক সহিংসতায় বৃহস্পতিবার উদ্বেগ জানাইয়াছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। বস্তুত আমাদের রাজনীতিকদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণেই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কূটনীতিকরা মন্তব্য করার অবকাশ পাইয়া থাকেন।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আমরা উভয় পক্ষকে দায়িত্বশীল ও সহিষুষ্ণ আচরণ করিবার আহ্বান জানাই। তাহাদের অসহিষুষ্ণতার কারণে একদিকে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হইতেছে, অন্যদিকে তাহাদের সংঘাতে সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী হইতেছে। আমরা বিশ্বাস করি, বিএনপি যেমন সংযম প্রদর্শন করিবে, তেমনি ক্ষমতাসীনদের তরফ হইতেও কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি অনুচিত। রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এখন সময়ের দাবি। বুধবার সংঘর্ষে মকবুল হোসেন কাহার আঘাতে প্রাণ হারাইলেন, তাহা তদন্তপূর্বক অপরাধীর শাস্তি এবং তাঁহার পরিবারের পাশে দাঁড়াইবার আহ্বান রহিল।