বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত ছিলেন একজন সমাজসংস্কারক। সে সময় মেয়েরা শিক্ষালাভ করবে, তাও আবার স্কুলে গিয়ে- এটি কল্পনার বাইরে ছিল। তিনি নারীশিক্ষা, নারীর অধিকার আদায়ে লড়াই করেছেন। তিনি বলেছেন নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার কথা। তিনি সবসময় বলতেন, 'মেয়েদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে, যাহাতে তারা ভবিষ্যৎ জীবনে আদর্শ গৃহিণী, আদর্শ জননী ও আদর্শ নারী হিসাবে পরিচিত হইতে পারেন।' একই সঙ্গে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি কখনও পুরুষদের ছোট করে দেখেননি। তাই তো তিনি লিখেছেন, 'আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কী রূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে?' তিনি মূলত নারী জাগরণের মাধ্যমে সমাজের কুসংস্কার মুছে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর চাওয়া ছিল- সমাজের উন্নয়ন ঘটাবে নারী-পুরুষ সমানতালে কাজ করার মাধ্যমে।

রোকেয়া শুধু নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেননি; তিনি মেহনতি মানুষের কথা বলতেন, বৈষম্যের শিকার মানুষের কথা বলতেন। তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত 'চাষার দুঃখ' প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধে তিনি কৃষকদের অমানবিক দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি শুধু নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাই বলেননি, বাস্তবেও তার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১৬ সালে বাঙালি মুসলিম নারীদের সংগঠন 'আঞ্জুমান খাওয়াতীনে ইসলাম' প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকে অসহায় নারীদের সহায়তা করা হতো বিভিন্নভাবে, বিধবা নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হতো, অসহায় ছাত্রীদের পড়ার খরচ দেওয়া হতো, দুস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করতেন। নিজে জমিদারকন্যা হয়েও সারাজীবন কাটিয়েছেন খুব সাদামাটাভাবে। কখনও বিলাসিতা করতেন না, নিজের সম্পত্তি ব্যয় করতেন সমাজসেবামূলক কাজে। এই অসামান্য অবদানের জন্য বাঙালি জাতি আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে। ২০০৪ সালে বিবিসির জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নারী জরিপের তালিকার ষষ্ঠ স্থানে উঠে আসে তাঁর নাম। এ ছাড়া প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়ার স্মরণে দেশে সরকারিভাবে পালিত হয় রোকেয়া দিবস। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পালিত হয় দিবসটি। এমনকি দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা নারীদের সরকারিভাবে প্রতি বছর দেওয়া হয় বেগম রোকেয়া পদক। এ ছাড়া তাঁর নামে দেশের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। ২০০৮ সালে বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান রংপুরে স্থাপন করা হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এই মহীয়সী নারীকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামে। এ রকম আরও স্থাপনা আছে দেশজুড়ে।

রোকেয়া এ উপমহাদেশে নারী স্বাধীনতার পথপ্রদর্শক। আজ এ দেশ ও সমাজের যতটুকু উন্নতি হয়েছে, বিশ্বের দরবারে যতটুকু মান পেয়েছে এই দেশ, তা সম্ভব হয়েছে নারী-পুরুষের যৌথ মেধা ও প্রচেষ্টায়। এ ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকার পেছনে বড় অবদান বেগম রোকেয়ার।

এই মহীয়সী নারী ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর নিজের জন্মদিনে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মাত্র ৫২ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে লোভ-লালসা, মোহ, খ্যাতি সবকিছু থেকে মুক্ত থেকে শুধুই দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে কাজ করে গেছেন। বাঙালি জাতি আজীবন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের কারিগর রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে। শুধু স্মরণ করলেই হবে না, তাঁর আদর্শ যাতে বাস্তবায়ন হয় সমাজে, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিককে। নারীকে নারী হিসেবে নয়, বিবেচনা করতে হবে মানুষ হিসেবে এবং মেহনতি মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় থাকতে হবে সবসময় সোচ্চার। তবেই বাস্তবায়ন হবে নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়ার স্বপ্নের দেশ।