বেগম রোকেয়া এমন এক অসামান্য নারী, যিনি এ দেশের অবহেলিত নারীসমাজকে দিয়েছেন এক অভাবনীয় আলোকবর্তিকার সন্ধান। বেগম রোকেয়া নারী অধিকার, চেতনা ও সমাজ নির্মাণ মানসিকতার যথার্থ রেখাপাত ঘটেছে তাঁর সৃজন ও কর্মে। নারী জাগরণ তথা নারীশিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া এক প্রদীপ্ত শিখা। তিনিই প্রথম বাঙালি নারী, যিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এই উপমহাদেশে নারীসমাজের মুক্তির একমাত্র পথ শিক্ষা ও স্বনির্ভরতা। রোকেয়া প্রগতিশীলতা ও আধুনিকতার নামে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের আদর্শ ও ঐতিহ্য বিসর্জন দেননি।

বাংলার নারীসমাজের মুক্তির অগ্রদূত ও জ্ঞানের আলো সঞ্চারিণী বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালে ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলায় পায়রাবন্দে বিখ্যাত জমিদার সাবের বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জহির উদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী সাবের চৌধুরী ও মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার বড় বোন করিমুন্নেসা ও বড় ভাই আবুল আসাদ মোহাম্মদ ইব্রাহীম সাবেরের হাতেই শৈশবে তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। ঐতিহ্যবাহী এই সাবের পরিবারে আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষার প্রচলন ছিল কিন্তু বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ছিল নিষিদ্ধ।

রোকেয়ার সহোদর ইব্রাহীম সাবের ও খলিলুর রহমান সাবের সর্বপ্রথম সাবের পরিবারের ঐতিহ্য ভেঙে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮৯৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভাগলপুর নিবাসী খান বাহাদুর সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে বেগম রোকেয়া বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছিলেন সে আমলে প্রথম সারির উল্লেখযোগ্য মুসলিম গ্র্যাজুয়েট (১৮৭৮ সালে মোহসেনের হুগলী কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন)। কর্মজীবনের শুরুতে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। সাখাওয়াৎ হোসেন যখন বিএ পাস করে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন, বেগম রোকেয়া তখনও জন্মগ্রহণ করেননি (বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালে)। সাখাওয়াৎ হোসেনের এটি দ্বিতীয় বিয়ে। এই অসম বিয়েতে বেগম রোকেয়ার গর্ভে দুটি কন্যাসন্তান জন্মের কিছুদিন পরই তাদের অকালমৃত্যু হয়। তাঁর স্বামী ১৯০৮ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে অকালেই মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র ২৮ বছর বয়সে বেগম রোকেয়া তাঁর স্বামীকে হারান। সাখাওয়াৎ হোসেনের আকস্মিক মৃত্যু বেগম রোকেয়াকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। তাঁর ১০ বছরের দাম্পত্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। অকাল বৈধব্য তাঁকে সে যুগে দমিয়ে রাখতে পারেনি। বেগম রোকেয়ার মনোবল ছিল অসীম। তাই তিনি তাঁর এই শোককে শক্তিতে রূপান্তর করেছিলেন। পরে মৃত স্বামীর সম্পত্তি নিয়ে প্রথম স্ত্রীর সন্তানদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ হওয়ায় স্বামীর মৃত্যুর মাত্র দুই বছর পরেই ১৯১০ সালে স্বামীর সঞ্চিত ১০ হাজার টাকা নিয়ে কলকাতায় পাড়ি জমান। ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ কলকাতার তালতলা অঞ্চলে ১৩ নং ওয়ালিউল্লাহ লেনের ভাড়া বাড়িতে মাত্র দুটো ক্লাস, দুটি বেঞ্চ আর আটজন ছাত্রী নিয়ে স্কুলের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। মরহুম স্বামীর নামানুসারে স্কুলের নাম দিয়েছিলেন 'সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল'। অভিভাবকদের আশ্বস্ত করে জানিয়েছিলেন স্কুলে কঠিনভাবে পর্দা মানা হবে। নিজে বোরকা পরে বাড়ি বাড়ি যেতেন ছাত্রী জোগাড় করতে। স্কুলের মিটিংও করতেন পর্দার অন্তরাল থেকে। এক পর্যায়ে স্কুলের ফান্ড শূন্য হলে তিনি বিত্তবানদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে স্কুল টিকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ ব্যাপারে রোকেয়ার হিতৈষীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খান বাহাদুর তসাদ্দক আহমেদ। 

মেয়েদের সার্বিক উন্নতির জন্য তিনি শিক্ষা গ্রহণকেই সর্বাগ্রে জোর দিয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল নারীকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। এ জন্য তিনি ১৯১৬ সালে কলকাতায় 'আঞ্জুমান খাওয়াতীনে ইসলাম' নামে মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শুধু স্কুল ও 'আঞ্জুমান খাওয়াতীনে ইসলাম' তৈরির মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বেগম রোকেয়া সে আমলে ছিলেন একজন নামকরা কবি ও সাহিত্যিক। মিসেস আর.এস হোসেন নামে সেকালের বিখ্যাত পত্রপত্রিকায় তিনি অসংখ্য কবিতা, উপন্যাস এবং নারীদের জন্য সমাজসচেতনমূলক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে অভিহিত বেগম রোকেয়ার সাহিত্যজগতে আবির্ভাব ঘটে বিশ শতকের শুরুতে ১৯০১ সালে 'নব প্রভা' পত্রিকায় 'পিপাসা' শীর্ষক রচনার মাধ্যমে।

বেগম রোকেয়ার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- মতিচুর, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, সুলতানার স্বপ্ন (ইংরেজিতে লেখা), সুবেহ সাদেক, অর্ধাঙ্গী, জাগো হে ভগিনী, স্ত্রী জাতির অবনতি, গৃহ ইত্যাদি। সাহিত্য রচনায় বেশিরভাগ সময় তিনি তাঁর নাম লিখতেন- মিসেস আর.এস হোসেন। দাপ্তরিক চিঠি বা অনাত্মীয়দের কাছে চিঠিতেও এই নামেই লিখতেন। একান্ত আপনজনদের কাছে লেখা চিঠিতে স্বাক্ষর করতেন 'রোকেয়া বা রোকেয়া খাতুন'।

রোকেয়ার সমাজচিন্তা ও সমাজ পরিবর্তনের বিশ্বাস আধুনিক মতবাদে উজ্জীবিত। নারীর কাঙ্ক্ষিত মুক্তিসাধন ও নারীশিক্ষায় উদ্দীপ্ত-প্রাণ বেগম রোকেয়া তাই চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবেন তাঁর আপন কীর্তি ও সৎকর্মের জন্য। 

রোকেয়া এ উপমহাদেশে প্রথম মুসলিম নারীবাদী আন্দোলনের একজন প্রবক্তা ছিলেন- একথা নিঃসংশয়ে বলা যায়। ১৯৮০ সালে বেগম রোকেয়াকে শর্তবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দুটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিল। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের এটি একটি মহৎ কাজ।

বেগম রোকেয়া ছিলেন সে আমলে নারী জাগরণের পথিকৃৎ ও অগ্রদূত। আমাদের গর্ব। বাঙালি জাতির প্রেরণার উৎস। সত্যি কথা বলতে, বেগম রোকেয়ার কৃতিত্ব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতোই। তিনি শুধু স্কুল প্রতিষ্ঠা কিংবা নারীশিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হননি; বরং সেই সঙ্গে ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সমাজে নারীদের অবস্থার সার্বিক উন্নতির জন্য অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন পুরুষ ব্যক্তিত্ব। বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন নারী। সে ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের চেয়েও বেগম রোকেয়ার কৃতিত্ব বেশি বলা যায়। সমকালীন সামাজিক অনুশাসনের অচলায়তন ভাঙা ছিল তাঁর লক্ষ্য। সুবিধাভোগী পুরুষের বিরুদ্ধে তাঁর ব্যঙ্গ ছিল, কিন্তু নিছক পুরুষবিদ্বেষ লালন করেননি অন্তরে। তাই নির্দি্বধায় তাঁর নামের সঙ্গে স্বামীর নাম যুক্ত করে নিজের সত্তাকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন।

১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে বেগম রোকেয়া মারা যান। বিশ্বমানের বিচারে আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া সমাজে আজ বেগম রোকেয়া চর্চার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বেগম রোকেয়া শুধু নারীর অধিকার ও জাগতিক মুক্তির কথাই বলেননি; প্রায় এক শতাব্দী আগে সাম্প্রদায়িকতাহীন মুক্ত জীবনবোধ ও জীবনাচরণে উৎসাহ দিয়েছিলেন।

কলকাতার লর্ড সিনহা রোডে বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল সরকারি বালিকা বিদ্যালয় আজও গৌরব ও ঐতিহ্য বহন করে চলছে।