রবীন্দ্রনাথ সর্বংসহা, বহুত্ববাদী ভারতের জয়গান করেছেন। আর্য, অনার্য, ইংরেজ, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান- সবাইকে ভারত সাগরতীরে এসে দাঁড়াতে আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, জন্মভূমির অভিষেকে যে মঙ্গলঘট ভরা হবে, সবার স্পর্শ ছাড়া তা পবিত্র হবে না। কিন্তু বিজেপির বর্তমান 'অসহিষুষ্ণ ভারত' রবীন্দ্রনাথের এ আহ্বান অগ্রাহ্য করে।

ভারতের সমাজ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ, যার বুকে সে বিচিত্র ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে আছে। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মুচকুন্দ দুবে এক নিবন্ধে লিখেছিলেন- ভারতের আত্মা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের ধারক এবং ধর্মনিরপেক্ষতা না থাকলে ভারত তার এককত্ব হারাবে, অখণ্ডতার বিনাশ হবে, অকালমৃত্যু ঘটবে।

স্বামী বিবেকানন্দ বেদান্ত দর্শনের সিংহভাগ শিক্ষার একান্ত অনুরাগী ছিলেন। তবে বেদান্তের শিক্ষাকে, সনাতন ধর্মের শিক্ষাকে তিনি ইহজাগতিকতার আলোকে গ্রহণ করার পক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ভারতে মুসলমানের আগমন ও বসবাস একটি বাস্তবতা। এখন হিন্দু-মুসলমানের শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ছাড়া গতি নেই। রামকৃষ্ণ উদ্ভাবিত 'যত মত তত পথ' তত্ত্বের শক্তিশালী প্রবক্তা ছিলেন তাঁর এই শিষ্য। মা সারদার একটি বিখ্যাত উক্তি তাঁর শিষ্যরা প্রায়ই আওড়ে থাকেন- 'হরেনও আমার ছেলে, বশিরও আমার ছেলে।'

অমর্ত্য সেন প্রাচীন ভারতে হিন্দু দর্শনের মধ্যকার বস্তুবাদী স্কুল লোকায়ত দর্শনের একান্ত অনুরাগী। তাঁর গর্বের জায়গাটা হলো প্রাচীন ভারতের বহুত্ববাদ ও যুক্তির আশ্রয়। আয়ুর্বেদের বিজ্ঞানও তাঁকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করে। প্রফেসর সেন 'আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়া' নামে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করে প্রাচীন ভারতে, বিশেষ করে চার্বাকের বস্তুবাদী ও লোকায়ত দর্শনের মাহাত্ম্যের কথা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন। এমনকি ঋগ্‌বেদের সৃষ্টির সংগীত অধ্যয়ন করে অমর্ত্য যখন দেখেন- ধর্মের মধ্যেও সংশয়বাদের ঐতিহ্য বর্তমান, তখন তিনি দারুণভাবে চমকিত হন, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।

সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে গান্ধী সারাজীবন হিন্দু-মুসলমানের মিলনের চেষ্টা করেছেন। বাঙালির মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম, সুভাষ বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ, শরৎ বসু, ঋষি অরবিন্দ, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তি এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলনের চেষ্টা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- 'আমাদের একটা মস্ত কাজ আছে, হিন্দু-মুসলমানে সখ্যবন্ধন দৃঢ় করা। অন্য-দেশের কথা জানি না কিন্তু বাংলা দেশে যে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সৌহার্দ্য ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। ... কিন্তু আজকাল শিক্ষিত সম্প্রদায়ের নূতন হিন্দুয়ানি অকস্মাৎ নারদের ঢেঁকি অবলম্বন করিয়া অবতীর্ণ হইয়াছে। তাঁহারা নবোপার্জিত আর্য অভিমানকে শজারুর শলাকার মতো আপনাদের চারি দিকে কণ্টকিত করিয়া রাখিয়াছে; কাহারও কাছে ঘেঁষিবার জো নাই।'

হিন্দুর ঘরে জন্ম নেওয়া যেসব মনীষীর কথা বলা হলো, তাঁরা কেউই ধর্মের গণ্ডিতে বাঁধা থাকেননি। তাঁরা মানবিকতাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। ভারতের যে কোনো নাগরিকের তাঁদের নিয়ে গর্ব করার কথা। কিন্তু বিজেপি তাঁদের কারও শিক্ষা-দর্শনই গ্রহণ করেনি। কারণ বিজেপি 'এক দেশ, এক জাতি, এক ভাষা, এক ধর্ম'তত্ত্বে বিশ্বাস করে।

ফ্রিডম ইন্ডেক্সে ভারত প্রথমবারের মতো ২০১৯ সালে আংশিক মুক্ত দেশ হিসেবে গণ্য হয়েছে, যে দেশটি ছিল সব সময় রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো- 'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির।' ফ্রিডম হাউসের গবেষকরা ২০২০ সালের রিপোর্টে এই অধঃপতনের জন্য তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন। এর আগে তাঁরা ব্যাখ্যা করেন, 'গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে নরেন্দ্র মোদির অধীন ভারত সরকারের প্রস্থান একটি ভয়ংকর লক্ষণ, যা মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা ভারতের যে ভাবমূর্তি, তা ম্লান করে দেয়।'

উল্লিখিত কারণগুলো এ রকম- ভারতের সংবিধান আর্টিকেল ৩৭০-এর আলোকে কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল, বিজেপি সরকার তা রদ করেছে। সৈন্য মোতায়েন করে ওখানকার নাগরিকদের মৌলিক অধিকার স্থগিত করে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা হয়েছিল। আসামে সিটিজেনস রেজিস্টার তৈরি করে রাতারাতি অনেক লোককে রাষ্ট্রহীন নাগরিকে পরিণত করা হয়েছিল। রেজিস্টার তৈরির কাজ অন্যান্য রাজ্যেও করা হবে বলে জানিয়েছিলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট আইনে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত শুধু হিন্দু নাগরিকদেরই ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান সংবিধান পরিপন্থি। বিজেপি সরকারের এসব পদক্ষেপ ধর্মীয় সংখ্যালঘুর মধ্যে সীমাহীন অসহায়ত্ব ও হতাশা সৃষ্টি করেছে। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের অস্তিত্ব বিপন্ন করতেই এসব বিধান করা হয়েছে।

বিজেপি যে কীভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছে, তা এক সময় ছিল কল্পনারও অতীত। ব্যাগের মধ্যে গোমাংস বহন করার সন্দেহে ট্রেনের মধ্যে কিশোর ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলা; আদিত্য যোগীর সভা থেকে মুসলিম নারীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া; রাস্তাঘাট, ট্রেন, বাসে মুসলমানদের জোর করে 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি দিতে বাধ্য করা- ইত্যাদি ঘটনা এই বিষবাষ্পের সাক্ষ্য বহন করে।

এসব প্রেক্ষাপটে বেবী সাউ রচিত 'আমাকে কাশ্মীর ভেবে' কাব্যগ্রন্থের নানা পঙ্‌ক্তিতে পাঠকের কানে বেজে ওঠে গভীর বেদনার সুর। সংখ্যালঘুর সঙ্গে একেবারে একাত্ম হয়ে তিনি যখন উচ্চারণ করেন- 'এ দেশ আমার নয়! এ দেশে অন্ধের চোখে জল/ ... আজ যেখানে যাও,/ রক্তাক্ত জরায়ু নিয়ে পড়ে আছে ভারত আমার', তখন আমাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়।

'দেশ' কবিতায় তিনি বলছেন- 'আমাকে কাশ্মীর বলে ছিঁড়ে খেলে, তুমিও ভারত-/ আমার আশ্রয়দাতা, আমার পুরুষ...'। 'শহীদ' কবিতায় তিনি ভারতের কাছে মিনতি করছেন, মৃতদেহ প্রাণহীন বলে তাঁকে নষ্ট না করতে; অনুরোধ করছেন তাঁকে ভালোবাসা দিতে। কবিতার ভাষায় তিনি যখন বলেন, 'তুমি তাঁকে ভালোবাসা দিও', তখন আমাদের মন ছুঁয়ে যায়। পাশাপাশি কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিজ ভূমি থেকে বিতাড়নের গল্প কবিতার যে শরীর নির্মাণ করে, তা-ও আমাদের মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি করে।

বেবী সাউ আমাকে চিঠি লিখেছেন। বলেছেন- "ড. তরুণ, বাংলাদেশের পত্রিকায় আপনার কলাম আমি নিয়মিত পড়ি এবং ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হই। আমি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কারসহ সাতবার সম্মাননা পেয়েছি। ২০১৫ থেকে এ পর্যন্ত আমার ১১টি কাব্যগ্রন্থ, দুটি অনুবাদের বই, তিনটি প্রবন্ধের বই প্রকাশকরা নিজেদের আগ্রহেই বের করেছেন। কিন্তু আমার লেখা 'আমাকে কাশ্মীর ভেবে' পশ্চিমবঙ্গের কোনো প্রকাশক ছাপাতে সাহস করল না। আমার দেশে এখন বিরাজ করে ভয়ের সংস্কৃতি। এই কাব্যগ্রন্থের একটি পিডিএফ কপি আপনাকে পাঠালাম। আপনি কি পারবেন এটা প্রকাশের ব্যবস্থা করতে?"

ব্যথায় ব্যথায় মন ভরে গেল। এই নিবন্ধের মধ্য দিয়ে প্রকাশকদের প্রতি বেবী সাউয়ের কাব্যগ্রন্থ 'আমাকে কাশ্মীর ভেবে' বের করার আহ্বান জানানো ছাড়া আমি আর কী বা করতে পারি! আমার ই-মেইল আইডিতে আগ্রহীদের চিঠি লেখার অনুরোধ করি।

ভারত বরাবরই উদার সংস্কৃতির দেশ ছিল। বহু মত ও বহু পথের অপার সৌন্দর্য ছিল এখানে। অথচ চোখের সামনে কীভাবে পাল্টে গেল দৃশ্যপট! ইউরোপ-আমেরিকাসহ যেসব দেশ উন্নতির পরাকাষ্ঠায় পৌঁছেছে; বহু সংস্কৃতি আর বহু মত যে সেই উন্নতির ভিত্তি; ভারতের কিছু লোক তা ভুলে বসে আছেন। ভুলে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতার অমোঘ বাণী- 'যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে/ পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।'

ড. এন এন তরুণ: ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড; সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ
nntarun@gmail.com