যুদ্ধের সময় যে কোনো প্রচারমাধ্যম প্রধানত দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। একটি হলো যুদ্ধসংক্রান্ত খবরাখবর জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া; দ্বিতীয়টি হলো উদ্বুদ্ধকরণ। এ দুটি করতেই সমর্থ ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান দেশ ও দেশের বাইরে সম্প্রচারিত হয়। ফলে এটি দেশের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল যেমন দৃঢ় করে; পাশাপাশি এসব অনুষ্ঠান দেশের বাইরে প্রচারিত হওয়ায় বিশ্বজনমত গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ চট্টগ্রামের কিছু কর্মী বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের মানসিক প্রস্তুতি নেন। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার শুরু হলেও পাকিস্তানি বাহিনী গোলাবর্ষণ শুরু করলে বেতারকর্মীরা সুরক্ষিত স্থানে চলে যান। আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। পরে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
১৯৭১ সালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। প্রবাসী সরকার এই বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমেই তাদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, নির্দেশনা প্রচারের জন্য পাঠাত। এগুলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হলে মুক্তিযোদ্ধারা সহজেই দিকনির্দেশনা পেতেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী প্রমুখের ভাষণ প্রচারিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানীর ভাষণও নিয়মিত প্রচারিত হতো। এসব ভাষণ শুনে জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা তেজোদীপ্ত হতেন।
সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখা ও বিজয়ের দিকে ধাবিত হওয়ার লক্ষ্যে প্রচারিত হতো বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। এর মধ্যে থাকত কথিকা, রম্য কথিকা, বিভিন্ন আশাজাগানিয়া গান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গান মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন সংকেত হিসেবে কাজ করত। নির্দিষ্ট গান সম্প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে শত্রুঘাঁটিতে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালাতেন।
নিয়মিত রণাঙ্গনের খবর, গণহত্যা ও পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার খবর প্রচারিত হতো। ফলে বিশ্ববাসী মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে পেরেছে। বিশ্ববাসী সহজেই স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবাণীর ওপর নির্ভর করতে হতো। যুদ্ধ যখন বিভিন্ন ফ্রন্টে নিয়মিত হতে শুরু করে; খবরের সোর্স ও বুলেটিনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এ ছাড়া যেসব সাংবাদিক রণাঙ্গনে ছিলেন, তাঁরা সংবাদ পাঠিয়ে বেতারকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের রঙ্গ-ব্যঙ্গাত্মক প্রচার 'চরমপত্র' বাঙালির মনোবল সুদৃঢ় করে। প্রতিদিন দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত চরমপত্র শোনার জন্য, যা পাঠ করতেন এমআর আখতার মুকুল। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি 'বিচ্ছু' বলতেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে প্রতিটি পরিবার রাতে ঘর অন্ধকার করে বালিশের নিচে ট্রানজিস্টর রেখে স্বাধীন বাংলা বেতার শুনতেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা আর গেরিলাদের বিজয় সংবাদ সম্প্রচারিত হতো। জানানো হতো কতজন পাকিস্তানি সৈন্য বা রাজাকার নিহত হয়েছে, কোন সেতুটি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব সংবাদ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার উৎস। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন আত্মসমর্পণ করে তখনই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় বিশেষ সংবাদ বুলেটিন। সে বুলেটিনের মাধ্যমে সবাই জানতে পারে- পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করেছে। প্রচারিত হয় আজ 'আমরা মুক্ত, স্বাধীন'। সংবাদটি কামাল লোহানী লেখেন এবং তিনি নিজেই পাঠ করেন। বিজয়ের মুহূর্তে গীতিকার সাংবাদিক শহীদুল হক খান তাৎক্ষণিক লিখতে শুরু করেন বিজয়ের গান। সুরকার সুজেয় শ্যাম সুরারোপ করতে থাকেন। গানটির দুই লাইন করে লেখা হয়, আর ততটুকু সুর করা হয়। শব্দসৈনিক শিল্পী অজিত রায়ের নেতৃত্বে সমবেত কণ্ঠে গানটি পরিবেশন করা হয়।
সুপা সাদিয়া :গবেষক, লেখক ও ঘোষক, বাংলাদেশ বেতার