বাংলাদেশের বিজয়ের এই ৫১ বছরেও বাঙালির মনে নানা শঙ্কা এখনও রয়ে গেছে; তার কারণ এই নয় যে, বাঙালি ভীরু। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়, ৯৫ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণ এবং তাদের দোসরদের লুকিয়ে পড়া- এ সবকিছুই বাঙালির সাহসের অসাধারণ প্রমাণ। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে একটি জাতির জাতিরাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সাফল্য এই প্রথম।
এই বিজয়ের জন্য বাঙালিকে কম মূল্য দিতে হয়নি। একটি স্বাধীন পতাকা, একটি সার্বভৌম মানচিত্র- এ অর্জনকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। সে জন্যই জয় বাংলা ধ্বনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যেমন এক অমোঘ মন্ত্র হয়েছিল; আজও সেটি আমাদের বিজয়েরই নিশ্চিত প্রতিধ্বনি। তবু রাবীন্দ্রিক উচ্চারণে বলি- 'জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না' বোধ করি এ কারণে নয় যে, বাঙালির মনটা ভীরু কিংবা বাঙালির প্রেমে কোনো খাদ আছে। সেটি কেবল এ কারণে যে, এই অর্ধশতকে বাঙালিত্ব ক্রমেই লোপ পাচ্ছে সেই সমাজ ও সংস্কৃতিতে, যার জন্য বাঙালির লড়াই ছিল দীর্ঘ দিনের। ৯ মাসের প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধ তো আসলে ২৩ বছর কিংবা বলা যায়, তারও আগে থেকে চলে আসা স্বাতন্ত্র্যবোধের লড়াইয়ের একটি সফল ও সম্প্রসারিত রূপ। এই সংগ্রামের সূচনা হয় যখন আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ ঘোষণা করেন- পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। উর্দুভাষী এই ব্যক্তি এবং অনেকে এই ভ্রান্তিতে ভুগছিলেন, উর্দু হচ্ছে ইসলামী ভাষা এবং পাকিস্তান যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্র হতে চলেছে, সেহেতু এর ভাষা হবে উর্দু।
এই ভ্রান্ত ধারণাকে তখনই সরাসরি নাকচ করে দেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌। তিনি বলেন, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হলে তা হবে বাঙালিদের জন্য রাজনৈতিক দাসত্ব স্বীকারের নামান্তর। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৮ সালে জিন্নাহও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বৈরতান্ত্রিক নির্দেশ দেন। বাংলা ভাষার জন্য প্রত্যক্ষ আন্দোলনের সূচনা তখনই। তার পরের ইতিহাস সবারই জানা।
কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি পাকিস্তানিদের এই বৈরিতার প্রধান কারণ কী? সবাই জানে, ভাষার সঙ্গে প্রাত্যহিক জীবনযাপনের যেমন সম্পর্ক আছে, তেমনি আছে সাহিত্য ও সংস্কৃতির। বাঙালিকে তার সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার অপপ্রয়াসে তখন এমনকি কেউ কেউ বলেছিলেন, তাহলে বাংলা ভাষা লেখা হোক আরবি হরফে। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিকে তার বিপুল সাহিত্যভাণ্ডার থেকে বঞ্চিত করে পাকিস্তানের নব্য সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নিবিষ্ট করা।
১৯৬১ সালে তাঁরাই প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের বিরুদ্ধে এবং এই পাকিস্তানপন্থিরাই বেতারে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে তাঁরাই হিন্দুয়ানি বলে নাকচ করেছিলেন। আসলে ধর্মের সঙ্গে ভাষা ও সংস্কৃতির অযৌক্তিক এক সমীকরণ সাধনের চেষ্টা চালিয়েছিল তখনকার পাকিস্তান সরকার এবং তার অন্ধ সমর্থকরা।


প্রশ্ন হচ্ছে, এখনও কি সাংস্কৃতিক আঙিনায় আমরা পাকিস্তানি প্রভাব দেখছি না? বাংলাদেশের স্বাধীনতার বহু বছর পরও তো রমনার বটমূলে, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে উগ্রবাদীরা হামলা চালিয়েছে। হামলা চালিয়েছে আরও কিছু স্থানে এবং এ সবকিছুই হচ্ছে ধর্মের নামে। অথচ খোদ ইসলাম ধর্মসহ কোনো ধর্মেই স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের সংঘাতের অবকাশ নেই। আসলে বারবার পাকিস্তানি প্রেতাত্মা ভর করে বাংলাদেশের ঘাড়ে। আশির দশকে বোধ হয় তদানীন্তন প্রশাসনের ইঙ্গিতেই কাবুলি পোশাক পরার চল শুরু হয়েছিল; সৌভাগ্যবশত তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বাংলাদেশের পোশাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে পরিবর্তন এসেছে বড় রকমের। হিজাব ও নিকাবের আধিক্য স্বভাবতই এ ভাবনা জাগিয়ে তোলে- আমরা মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে কোথায় চলে এসেছি!
আমরা জানি, বৈশ্বিক কারণে এসব পরিবর্তন এমনকি পশ্চিমেও ঘটেছে। কিন্তু বাঙালি তো ভুলে যায়নি সেই '৬৯-'৭১-এর দিনগুলোর কথা, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা শাড়ি পরেই পথে নামতেন মিছিলে। হয়তো অনেকেই বলবেন, বিজয় দিবসের সঙ্গে পোশাকের সম্পর্ক কোথায়? আমি কি ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি? বিষয়টা তা নয়। পোশাক তো সংস্কৃতিরই অংশ। বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রাম ছিল বাঙালি সংস্কৃতি সংরক্ষণে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি এসেছে নিঃসন্দেহে এবং উন্নয়ন হয়েছে ঈর্ষণীয় রকমের। কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতি ক্রমেই অধীন হয়ে পড়ছে ভিন্ন সংস্কৃতির; আর তাও কথিত ধর্মের নামে। অথচ বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষ বা অসাম্প্রদায়িক আদর্শের ভিত্তিতে। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এসেছে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই বাংলা ভাষা ব্যবহার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এ নিয়ে অভিভাবকরাও বোকার স্বর্গে বাস করছেন। তাঁরা গর্ব বোধ করছেন এই বলে- ইংরেজি মাধ্যমে পড়া তাঁর সন্তান বাংলা ভালো বলতে পারে না।
এর সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে হিন্দির আধিপত্য। এসব শিক্ষার্থী হিন্দি চলচ্চিত্রের প্রভাবে চট করে হিন্দি বলে ফেলে। অথচ বাংলা বলতে যত সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব্ব। যে বাঙালি উর্দুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তার পক্ষে হিন্দির এই অকারণ প্রসার একেবারেই যথার্থ নয়। কোনো ভাষার প্রতি আমাদের বৈরিতা থাকার কথা নয়। কিন্তু নিজের ভাষাকে বিসর্জন দেওয়া কোনোভাবেই সমর্থন পেতে পারে না।
বাংলাদেশের মানুষের জন্য অবশ্য সবচেয়ে আশঙ্কার জায়গাটা হলো সাম্প্রদায়িকতা। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবে ইসলাম ধর্মকে আচারসর্বস্ব করে তোলায় সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব বেড়ে চলেছে। ভক্তির চেয়ে শক্তির ওপর নির্ভর করায় কেন জানি আমরা ক্রমেই এমন এক ভিন্ন পথে হাঁটছি, যা আমাদের একাত্তরের আদর্শ থেকে ধীরে ধীরে দূরে নিয়ে চলেছে। সে জন্য সেদিনকার সেই জয় সত্ত্বেও এখনও বাঙালির বাস ভয়ের মধ্যেই।
আনিস আহমেদ: লেখক ও সাংবাদিক