মধ্য আগস্ট; ১৯৮৭। বার্লিন লিটারাটুর হাউস। প্রশস্ত লন। গাছগাছালি। গ্রীষ্ফ্মের হরেক ফুল। সাজানো এবং অগোছালো চেয়ারটেবিল। ইতস্তত। পড়ন্ত বিকেল। ফুরফুরে হাওয়া, খাদক-খাদিকা গল্প-আড্ডায় মশগুল। পানীয়।

লিটারাটুর হাউস লেখক-শিল্পীর নরক গুলজারের সন্ধ্যার আগেই সরগরম। বাইরের লোকেরও প্রবেশ। বাধাহীন। রচনা থেকে পাঠ ছাড়াও সাহিত্য সমাবেশ। নানা দেশের লেখক উপস্থিত। আলোচনা।

মনে পড়ল কলকাতার কফি হাউস। কলেজ স্ট্রিট।

কলকাতায় আরও তিনটি কফি হাউস। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে দুটি। একই বিল্ডিংয়ে। নিচতলায়। পাশাপাশি। একটির নাম কমনস্‌। একটির নাম লর্ড। কমনস্‌-এ সাধারণ মানুষ। লর্ড-এ এলিট। বিত্তবান।

সন্ধ্যার পরেই কমনস্‌, লর্ড বন্ধ।

যাদবপুরের কফি হাউস সন্ধ্যার পরেই জমজমাট। কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসও (বিকেলের আগে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী)। লেখক-শিল্পী, লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক। নাটকের অভিনেতা। সিনেমারও (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ প্রায়-নিয়মিত। দু'জনেরই মূল শিকড় নাটক)।

বার্লিনের লিটারাটুর হাউসে কোনো অভিনেতা দেখিনি। হয়তো এসেছেন। অচেনা।

এক টেবিলে জনা-পাঁচেক। একজন উঠে এসে আমাদের আড্ডায়। আসীন।

গু্যয়েন্টার গ্রাস পরিচয় করিয়ে বললেন, ওঁর নাম হানস মাগনুস এনসেনবার্গার। আমাদের কালের মহত্তম কবি। গোটা বিশ্বেই। ঈর্ষা করি ওঁকে। অনেকেরই ঈর্ষণীয়।

জার্মান ভাষা অজানা। ৩৫ বছর আগের কথা বলছি।

খোঁজ নিলুম এনসেনবার্গারের কবিতা ইংরেজি অনূদিত কিনা, বই কোথায় পাওয়া যাবে। পেলুম তৎকালীন পূর্ব বার্লিনে। পড়ে তাজ্জব।

আলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ফোনে বলেন: 'মূল ভাষায় পড়লে জানবে সমসাময়িককালের কবির কবি। কবিতায় ওঁর ইমেজ, বাক্য গঠন, কবিতার ভাষা দূরান্বিত প্রত্যয়াগামীর চেয়েও রহস্য। পাঠক আন্দোলিত। কবিকেও প্রভাবিত করে। অনুসরণ অসম্ভব। চেষ্টা করেছি। বিফল। বাংলা কবিতায় অচল। বাংলা কবিতার মেদুরতা এখনও।'

অধ্যাপক বিনায়ক সেন জানান, 'এনসেনবার্গার ওঁর প্রিয় কবি।' পড়েছেন ইংরেজি অনুবাদ।

বাংলায় প্রথম অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। বই প্রকাশিত। মানবের অনুবাদগ্রন্থ পেয়ে এনসেনবার্গার বিস্মিত। আনন্দিত। জানতে চান, 'জার্মান থেকে অনুবাদ কিনা।' বাংলা ভাষা ওঁর অচেনা। বলি, 'জার্মান থেকে ইংরেজি অনুবাদ। ইংরেজি থেকে বাংলায়।'

'না, না, তৃতীয় অনুবাদ অপাঠ্য। প্রকাশক জানলে মামলা করবে।'

আশ্বস্ত করি গ্যয়টে, হোয়েলডারলিন, রিলকেও ইংরেজি থেকে বাংলায় অনূদিত। তৃতীয় ভাষা হলেও অনুবাদক অনেকটাই মূলাগত। ভাষা জানা অনেকের সাহায্যে।

এনসেনবার্গারের মুখ বেজার।

এনসেনবার্গারের জন্ম ১১ নভেম্বর ১৯২৯, মৃত্যু ২৪ নভেম্বর ২০২২, মিউনিখে।

কেবল কবি নন। অনুবাদক। সম্পাদক। গল্পকারও।

'ড্যের উন্টারগাং ড্যের টিটানিক' (১৯৭৮), ইউরোপ, ইউরোপ (১৯৮৭), দ্য নাম্বার ডেভিল (১৯৯৯), দ্য সাইলেন্স (২০০৮) বহুল পঠিত।

নোবেল ছাড়া গোটা বারো পুরস্কার পেয়েছেন, ২০১০-এ নিউইয়র্ক থেকে বোর্ড কলেজের অনারারি ডক্টরেট।

নোবেল পুরস্কারের লিস্টে দুইবার নাম, ফাইনালেও একবার। পাননি, না পেলেও ওঁর কথা :'পুরস্কারই কি কবিতার বিচার, মাপকাঠি?'

এনসেনবার্গারের একটি কবিতার অনুবাদ।

জীবন

মূঢ়তার নানা প্রকাশ। জলতরঙ্গের মূঢ়তায় যে-ধ্বনি

অব্যক্ত ছাড়া কিছু নয়।

ব্যক্ত ও ধ্বনির বীক্ষণে নির্মোহ রূপ, সময়ের

বিস্তীর্ণ চেহারা।

সূর্যোদয়ের আগে মলিন আঁধার, মত্ত পিশাচ অদৃশ্য।

ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে আছে আমার স্বপ্ন, মৃত্যুর পরে স্বপ্ন

আলোকস্তম্ভে জাগরিত।

সৌন্দর্যের নানা স্তর। সৌন্দর্যের রূপ নানা হিল্লোহে।

ঊর্মিমালায় নৃত্য। জীবন প্রবাহিত। জল আবর্তিত।

দাউদ হায়দার: কবি