একই পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যকার মেধার তারতম্যের দায় অনেকে 'জিন'-এর ওপর চাপান। অথচ জিনের দিক থেকে মানুষে মানুষে খুব একটা পার্থক্য নেই। অন্য কিছু কারণে মানুষভেদে মেধার ভিন্নতা দেখা দেয়। সেই কারণগুলো নিয়ে আলোচনা করলে মেধা-সমতা বা মেধা-বৈচিত্র্য লাভ সহজতর হবে।

মেধার ক্ষেত্রে অসাম্য তৈরি হওয়ার একটা বড় কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য। স্ট্যানফোর্ডের শিক্ষা মনস্তত্ত্ব্ব বিশেষজ্ঞ লুইস টারম্যানের 'জিনেটিক স্টাডিজ অব জিনিয়াস' নামে এক বিখ্যাত গবেষণা আছে। সেখানে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার আড়াই লাখ স্কুল শিক্ষার্থীর আইকিউ মাপেন। তার পর সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া ১২০ জনকে আলাদা করে নেন। এদের সবার স্কোরই ১৪০ কিংবা তার বেশি ছিল। টানা ২০-৩০ বছর পর্যবেক্ষণ করে টারম্যান দেখেন, এদের ভেতর ওপরের দিকের ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাকিরা জীবনে তেমন সাফল্য পায়নি। টারম্যান এর কারণ খুঁজলেন। এটা কি তাদের ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিগত অভ্যাস, না অন্য কিছু? দেখা গেল, মূল কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য। অর্থাৎ সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা সফল হয়েছে; আর দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা খুব ভালো আইকিউ থাকা সত্ত্বেও পিছিয়ে গেছে।

বয়সের কারণেও মেধা নষ্ট হতে পারে। বিখ্যাত লেখক ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল একবার নামিদামি স্পোর্টস টিমগুলোর খেলোয়াড়দের জন্মতারিখ সংগ্রহ করলেন। যেমন ২০০৭ সালের জুনিয়র চেক হকি টিমের খেলোয়াড়দের জন্মতারিখ খেয়াল করে দেখলেন, ২০ জনের মধ্যে ১১ জনের জন্মতারিখ জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে। বাকি বেশিরভাগ এপ্রিল, মে ও জুনের ভেতর। এটা দেখে তাঁর কৌতূহল হলো। দেখা গেল, সারা পৃথিবীতে সকার ও হকি টিমের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের জন্মতারিখ ওই জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চের ভেতর। অনুসন্ধান করে এর কারণ পাওয়া গেল- কোনো স্পোর্টস ক্লাবে যখন প্রথম বাচ্চাদের নেওয়া হয় তখন বেশিরভাগ দেশেই কাট-অফ পয়েন্টের তারিখ থাকে ১ জানুয়ারি। অর্থাৎ ঐ দলে যার জন্মতারিখ ১ জানুয়ারি, বয়সে সে-ই ওই দলের সবচেয়ে বড় হয়। ১০ বছরের বাচ্চাদের একটি দলে একজনের সঙ্গে আরেকজনের কয়েক মাসের পার্থক্যও অনেক বড়। ফলে যাদের জন্মতারিখ জানুয়ারি বা তার কাছাকাছি কোনো মাসের, তারা অন্যদের চেয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক পরিপকস্ফ হয়। স্বাভাবিকভাবে ওরা অন্যদের চেয়ে অনেক ভালো খেলে এবং দ্রুত কোচদের নজর কাড়ে। ফলে ওরাই বেশি মনোযোগ, ট্রেনিং ও যত্ন পায় এবং ওরাই শেষ পর্যন্ত টিকে যায়।

শিক্ষাক্ষেত্রেও একই কথা। কয়েক হাজার আমেরিকান স্কুল শিক্ষার্থীর ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, একই ক্লাসের তুলনামূলক বয়সে বড় শিক্ষার্থীরা ভালো করে এবং ছোট শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে যায়। এই ছোট শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার হার তাদেরই সহপাঠী বড় শিক্ষার্থীদের চেয়ে ১১ শতাংশ কম।

দৃষ্টিভঙ্গির কারণেও প্রতিভা নষ্ট হয়। সেটা ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক দুই-ই হতে পারে। যে শিক্ষার্থী মনে করে, সে পারবে; তার পারার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আর যে শিক্ষার্থী মনে করে, সে পারবে না; তার পারার সম্ভাবনা কমে যায়। এটা এখন প্রায় সর্বজনস্বীকৃত ও প্রমাণিত- এশিয়ানরা পশ্চিমাদের চেয়ে গণিতে অনেক ভালো। অন্য সবকিছু এক থাকার পরও এশিয়ানরা গণিতে কেন এত ভালো হয়, তার কারণ খুঁজতে গিয়ে ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল দেখলেন, এর মূল কারণ দৃষ্টিভঙ্গি। এশিয়ান শিক্ষার্থীরা যখন গণিতের কোনো সমস্যা সমাধান করতে বসে তখন তারা ধরেই নেয়- তাদের পক্ষে সেটা সমাধান করা সম্ভব। অন্যদিকে পশ্চিমা শিক্ষার্থীরা মনে করে, যারা গণিতের সহজাত ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়, শুধু তারাই গণিত পারে; অন্যদের চেষ্টা করে লাভ নেই। শুধু এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই তারা এশিয়ানদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে।

'টিমস' নামে যে আন্তর্জাতিক টেস্ট চার বছর পরপর বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য গণিত টেস্টের প্রশ্ন ছাড়াও গবেষণার প্রয়োজনে এক সেট প্রশ্ন দেওয়া হয়। সেই সেটে গণিতচর্চা করতে কেমন লাগে, তাদের বাবা-মা তাদেরকে কেমন সহযোগিতা করেন ইত্যাদি প্রায় ১২০টি প্রশ্ন থাকে। যেহেতু বাধ্যবাধকতা নেই, সব শিক্ষার্থী এত প্রশ্নের উত্তর দেয় না। দেখা গেছে, যে দেশের শিক্ষার্থীরা যত বেশি এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়, মূল টেস্টের র‌্যাঙ্কিংয়ে সে দেশ তত এগিয়ে যায়। এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সঙ্গে টেস্টে ভালো করার কোরিলেশন খুব ভালো- দশমিক ৯। অর্থাৎ এই দুইয়ের মধ্যে বস্তুত কোনো পার্থক্য নেই। এটা প্রমাণ করে, যে শিক্ষার্থী যত ধৈর্য নিয়ে যত বেশি সময় এক জায়গায় বসে থাকতে পারে, সেই শিক্ষার্থী গণিতে তত ভালো হয়।

গ্ল্যাডওয়েল বলেন, গণিতের ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে যে পার্থক্য সেটা মূলত শিক্ষার্থীর দৃষ্টিভঙ্গিনির্ভর। এই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় একটি অঞ্চলের কাজের সংস্টৃ্কতি থেকে। তাঁর মতে, এশিয়ানরা যে এত ধৈর্য ধরে গণিতে মনোনিবেশ করতে পারে, তার কারণ তাদের দীর্ঘ দিনের ধান উৎপাদন করার জটিল ও কঠিন কাজ করার অভ্যাস। যেমন চায়নিজরা ধান চাষ করার জন্য সারাবছর সকাল-সন্ধ্যা পরিশ্রম করত। অন্যদিকে ইওরোপিয়ানরা গম উৎপাদন করার জন্য মাঠে কাজ করত বড় জোর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত; তাও সারাবছর না। গ্ল্যাডওয়েলের মতে, দীর্ঘ, কঠোর ও জটিল পরিশ্রম করার সহস্র বছরের লালিত এই সংস্কৃতির আবহে বড় হওয়ার কারণেই এশিয়ান শিক্ষার্থীরা গণিতের প্রতি এমন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।

অর্থাৎ আপনি যদি দারিদ্র্য দূর করতে পারেন; বয়সভেদের কারণে সৃষ্ট সমস্যা মোকাবিলায় শিক্ষার্থীদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেন এবং শিক্ষার্থীদের ভেতর একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারেন, তাহলে প্রতিভা অপচয়ের মতো একটি বিশাল ও অপূরণীয় জাতীয় ক্ষতি অনেকাংশে ঠেকাতে পারবেন।

আমাদের দেশে এই মুহূর্তেই দারিদ্র্য নির্মূল করা সম্ভব নয়। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মনোবল ঠিক রাখার ব্যবস্থা নেওয়া যায়। বয়সভেদের কারণে সৃষ্ট সমস্যাও দূর করা কঠিন। তবে শিক্ষকরা সচেতন হলে এর অন্তত আংশিক সমাধান সম্ভব। আর দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে এশিয়ান হিসেবে আমরা এমনিতেই সুবিধাজনক অবস্থায় আছি। শিক্ষকরা চাইলে খুব সহজে তা কাজে লাগাতে পারেন।

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক: মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক